পরিকল্পনা অনুযায়ী মা-বাবা-ভাইয়ের সঙ্গে ঈদের আগের দিন মাতৃভূমিতে এলো প্রীতম। দেশে থাকা স্বজনদের কোলে-পিঠে আদরে-আহ্লাদে উচ্ছ্বাস-আনন্দে কাটলো ঈদ।
কিন্তু কে জানতো, মা-বাবার দেশের এই ভালোবাসাই ক’দিন পরে পরিণত হবে অবহেলায়? যে নিদারুণ অবহেলা তাকে নিয়ে যাবে না ফেরার দেশে! আর কখনো ফিরতে দেবে না তার জন্মশহর, তার বেড়ে ওঠার শহর প্যারিসে! খেলতে দেবে না ভাইয়ের সঙ্গে ডিজনিল্যান্ড পার্কে প্রিয় রাইডসগুলোতে!
মা-বাবার দেশের হাসপাতালের অবহেলায় প্রীতম চলে গেছে না ফেরার দেশে। পঞ্চম জন্মদিন উদযাপনের নয় দিনের মাথায় গত শুক্রবার (১৪ জুলাই) জ্বরে আক্রান্ত হয়ে কুমিল্লার মিডল্যান্ড হাসপাতালের চিকিৎসা-উদাসীনতায় মৃত্যু হয়েছে প্রীতমের।
প্রীতম আলম অন্তু ছিল ফ্রান্সের প্রবাস বাংলার সম্পাদক আলমগীর হোসেন অপু আলম ও নাজিয়া আলম দম্পতির আদরের সন্তান। প্যারিসে বসবাস করলেও এ পরিবারের বাড়ি কুমিল্লার সদর দক্ষিণের বাগমারা এলাকায়। ঈদে দেশে এসে তারা থাকছিলেন নগরীর চকবাজার এলাকায়। আলমগীর-নাজিয়ার আরেক সন্তান ফাহিম। প্রীতমের মৃত্যুতে বাবা-মা যেমন বারবার মূর্চ্ছা যাচ্ছেন, শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েছে বড় ভাই ফাহিমও।
স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত শুক্রবার সকালে জ্বরে আক্রান্ত হয় প্রীতম। চিকিৎসার জন্য তাকে নেওয়া হয় কুমিল্লা শহরের লাকসাম রোডের মিডল্যান্ড হাসপাতালে। এখানে পরীক্ষার জন্য প্রীতমের শরীর থেকে নেওয়া হয় রক্ত।
পরীক্ষার ল্যাবরেটরিতে টেকনিশিয়ান না থাকায় সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়। জ্বরে প্রায় বেহুঁঁশ প্রীতম। কিন্তু তখনো রিপোর্ট পাওয়ার নাম নেই। খোঁজ মেলে না টেকনিশিয়ানের। কী নিদারুণ অবহেলা! বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামে। খোঁজ মেলে সংশ্লিষ্টদের। খানিকবাদে রিপোর্ট আসে ডাক্তারের কাছে।
রিপোর্ট দেখে চিকিৎসকের হতভম্ভ হওয়ার দশা। বললেন, শিগগির ঢাকায় নিতে হবে প্রীতমকে। তাকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স রওয়ানা হলো ঢাকায়। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। মা-বাবার মমতা-স্নেহের বুক খালি করে প্রীতম ছেড়ে গেছে পৃথিবীর মায়া। রাত সাড়ে ৯টায় ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে পৌঁছানোর পর তাকে চিকিৎসকের মৃত ঘোষণা ছিল কেবলই ‘ফরমালিটিজ’।
বাবা মানতে পারছেন না, ছুটির দিন বিকেলে তার সঙ্গে প্রীতম আর খেলা করবে না। বায়না ধরবে না পার্ক ঘুরে আসার। মা মানতে পারছেন না, তার কলিজার টুকরো তাকে আর কোনো প্রিয় খাবারের জন্য আবদার করবে না। ধরবে না তার বুকে চুপটি মেরে ঘুমিয়ে থাকার বায়না। বড় ভাই ফাহিম তার নিথর দেহের পাশে উপুড় হয়ে বসে ভাবতে পারছে না, এই পুঁচকে ভাইটা আর কিছু নিয়ে তার সঙ্গে ঝগড়া-খুনসুটি করবে না। সেই ঝগড়া ভুলে আবার খেলবেও না।
মিডল্যান্ড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় প্রীতমের মৃত্যুর ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে চলছে সমালোচনার ঝড়। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত প্রীতমের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে সবাই দাবি করছেন সুষ্ঠু তদন্ত ও গাফেলতির বিচার।
প্রীতমের আত্মীয়-স্বজনরা জানান, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সঠিক সময়ে চিকিৎসা করলে এই কোমলপ্রাণ শিশুটিকে অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হতো না। তারা শুধু অবহেলা করেছে। এর সুষ্ঠু বিচার দরকার।
এ বিষয়ে জানতে মিডল্যান্ড হাসপাতালের টেলিফোনে একাধিকবার কল করলেও কেউ রিসিভ করেননি।
যোগাযোগ করলে কুমিল্লার সিভিল সার্জন ডা. মুজিবুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, প্রীতমের মৃত্যুর বিষয়টি আজ সকালে জানতে পেরেছি। হাসপাতালের গাফেলতির বিষয়ে এখন পর্যন্ত কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। যদি অভিযোগ আসে, তদন্ত কমিটি গঠন করবো। তদন্তে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের গাফেলতি ধরা পড়লে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৮ ঘণ্টা, জুলাই ১৫, ২০১৭
এইচএ/