বুধবার (১২ জুলাই) পটুয়াখালী সদর উপজেলার জৈনকাঠি ইউনিয়নের পূর্ব জৈনকাঠি গ্রামের নিজ বাড়িতে বসে কথায় কথায় আদুরী যখন তার মাদ্রাসার নাম বলছিলো, তখন মনে হচ্ছিলো, পূর্ব জৈনকাঠি সানিয়া দাখিল মাদ্রাসা। পরে তার বড় ভাই সোহেল মৃধা বলে দেন, সানিয়া নয়, সালেহিয়া মাদ্রাসা।
অল্প বয়সে বাবাকে হারানোর পর অভাবের কারণে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে ঢাকায় যাওয়া আদুরী চার বছর আগে হয়েছিল নির্মম নির্যাতনের শিকার। মৃত ভেবে বারিধারা ও ডিওএইচএস তেলের ডিপোর মাঝামাঝি রেললাইন সংলগ্ন ডাস্টবিনে তাকে ফেলে দিয়েছিলেন ওই বাড়ির লোকজন।
২০১৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ডাস্টবিনের পাশ থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয় কঙ্কালসার ও মৃতপ্রায় শিশু গৃহকর্মী আদুরীকে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে প্রায় দেড় মাসের চিকিৎসার পর ক্ষতচিহ্ন নিয়ে মা আর ভাই-বোনদের সঙ্গে থাকতেই বাড়িতে চলে আসে আদুরী।
গ্রামের পূর্ব জৈনকাঠি সালেহিয়া দাখিল মাদ্রাসায় তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে এখনকার ১৪ বছরের আদুরী।
আরও পড়ুন
** লেখাপড়া চালিয়ে যেতে চায় আদুরী
** এখনো ক্ষত-যন্ত্রণা বয়ে চলেছে আদুরী
** ‘আমি নদীর ফাঁসি চাই’
নতুন কেউ আদুরীর সঙ্গে কথা বলতে গেলে আরো অনেক কথাই বোঝেন না। তবে পরিবারের সদস্যরা অনেকটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছেন।
সাধারণ মানুষ যেভাবে দ্রুত কথা বলতে পারেন, শুধু জিহবা’র অগ্রভাগের কিছু অংশ না থাকায় তাও পারে না নির্যাতিতা মেয়েটি। সময় নিয়ে কথা বলতে বলতে অনেক কিছু আবার মনেও রাখতে পারে না।
সব সময় মাথায় কাপড় দিয়ে চলা আদুরীর চাল-চলন, হাসিমাখা মুখ দেখে অনেক সময়ই মনে হয় না, তার অতীতে ঘটে গিয়েছিলো ভয়ঙ্কর-পাশবিক নির্যাতনের নিষ্ঠুর ঘটনা।
তবে যখন কেউ তার মুখ কিংবা হাত, মাথা কিংবা শরীরের অন্যান্য অংশ দেখেন তখন আঘাতের চিহ্নগুলোই বলে দেয়, কতোটা নির্মমতার পরিচয় দেওয়া হয়েছিলো তার সঙ্গে।
আদুরীর মা সাফিয়া বেগম জানান, তার ৯ ছেলে-মেয়ের মধ্যে আদুরী ৭ নম্বরের। তাদের বাবা খালেক মৃধা মারা গেছেন ৬/৭ বছর। ডাস্টবিন থেকে মুমূর্ষু আদুরীকে উদ্ধারের এক বছর আগে স্থানীয় ঠিকাদার চুন্নু মিয়া আদুরীকে তার শ্বশুর বাড়িতে কাজে নেন। এরপর সেখানে থেকে চুন্নু মিয়া তার স্ত্রীর ভাই সাইফুল ইসলাম মাসুদের বাড়িতে ঢাকায় কাজে পাঠান। ওই বাড়িতেই সে সময়কার ১১ বছরের শিশুটিকে অনেকদিন ধরে নির্যাতন চালানো হচ্ছিল মাসুদের স্ত্রী নদীর নেতৃত্বে।
তিনি জানান, আদুরীকে মারধর করা হতো, শরীরে খুন্তি ও আগুনের ছ্যাঁকা দেওয়া হতো। মাথায় ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। রয়েছে বুকে আয়রন মেশিনের ছ্যাঁকার দাগ, জিহবায় আগুনের ছ্যাঁকাসহ নানা কিছু। সেসব ক্ষত শুকিয়ে গেলেও আজো যায়নি দাগ, ভরাট হয়নি গর্ত হয়ে যাওয়া শরীরের ক্ষতগুলো, মাথার আঘাতস্থলে ওঠেনি চুলও। বরং শরীরের ক্ষতগুলোর অনেক জায়গায়ই নতুন করে শক্ত হয়ে টিউমারের মতো জেগে উঠছে।
নির্যাতনের সব বিষয় আদুরীর এখন মনে না থাকলেও এ ঘটনায় মামলা শেষ হয়ে আগামী ১৮ জুলাই রায় দেওয়া হবে, তা তার জানা। অস্পষ্ট ভাষায় মায়ের সঙ্গে তাই বলে, ‘এর বিচার আমি চাই’।
ভাই সোহেল মৃধা বলেন, ‘আমার বোনরে যে নিয়া এই দোজগের আগুনে ফালাইছছেন, সেই চুন্নু মিয়া আগে থাইকা ছাড়া পাইয়া গেলেন, এখন কি হবে তাও আল্লাহই জানেন’।
তিনি বলেন, ‘কয়েকদিন আগে ঢাকায় উকিলের লগে কথা হইছে। তিনি ঢাকায় যাওয়ার কথা কইছেন। কিন্তু ঢাকায় যাওয়ার ট্যাকাই তো নাই’।
ঘটনার তিনদিন পরে ২৬ সেপ্টেম্বর পল্লবী থানায় গৃহকর্ত্রী নওরীন জাহান নদী, তার স্বামী সাইফুল ইসলাম মাসুদ, মাসুদের দুলাভাই চুন্নু মীর ও তাদের আত্মীয় রনিকে আসামি করে মামলা করেন আদুরীর মামা নজরুল চোধুরী। তবে পুলিশি তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় চার্জশিট থেকে মাসুদ, চুন্নু মীর ও রনিকে বাদ দেওয়া হয়। তদন্তে নদীর মা ইসরাত জাহানকে নতুন করে তাকে আসামি করা হয়।
এ মামলায় গৃহকর্ত্রী নওরীন জাহান নদী ও তার মা ইসরাত জাহানের বিচার শেষ হয়েছে। আগামী ১৮ জুলাই রায় দেবেন ঢাকার ৩নং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক জয়শ্রী সমাদ্দার। নদী কারাগারে আটক থাকলেও জামিনে আছেন তার মা ইসরাত।
বাংলাদেশ সময়: ২২২০ ঘণ্টা, জুলাই ১৩, ২০১৭
এমএস/এএসআর