ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

লেখাপড়া চালিয়ে যেতে চায় আদুরী

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২০ ঘণ্টা, জুলাই ১৩, ২০১৭
লেখাপড়া চালিয়ে যেতে চায় আদুরী সময় মতো পড়তে বসে আদুরী। ছবি: বাংলানিউজ

পটুয়াখালী থেকে ফিরে: নির্যাতনের ক্ষতচিহ্ন মোছেনি, রয়ে গেছে শারীরিক যন্ত্রণা, তারপরও পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত সময় পার করছে নির্যাতিতা শিশু আদুরী।

অল্প বয়সে বাবাকে হারানোর পর অভাবের কারণে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে পটুয়াখালীর বাড়ি থেকে ঢাকায় যাওয়া আদুরী গৃহকর্ত্রী নওরীন জাহান নদীর হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার। সে সময়কার ১১ বছরের আদুরীকে মারধর, গরম ইস্ত্রি, খুন্তি, চামচ বা তেলের ছ্যাঁকা, ব্লেড দিয়ে শরীর পোঁচানো, মাথায় কোপ, মুখে আগুনের ছ্যাঁকা, খেতে না দেওয়াসহ ভয়াবহ সব নির্যাতন চালানোর পর মৃত ভেবে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিলেন নদী।

   

২০১৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানীর বারিধারা ও ডিওএইচএস তেলের ডিপোর মাঝামাঝি রেললাইন সংলগ্ন ওই ডাস্টবিনের পাশ থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয় কঙ্কালসার ও মৃতপ্রায় শিশু গৃহকর্মী আদুরীকে। উদ্ধারের সময় তার শরীরে ছিলো অসংখ্য নির্যাতনের চিহ্ন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে প্রায় দেড় মাসের চিকিৎসার পর ক্ষতচিহ্ন নিয়ে মা আর ভাই-বোনদের সঙ্গে থাকতেই পটুয়াখালী সদর উপজেলার জৈনকাঠি ইউনিয়নের পূর্ব জৈনকাঠি গ্রামে চলে আসে আদুরী।

উদ্ধারের চার বছর পর গ্রামের পূর্ব জৈনকাঠি সালেহিয়া দাখিল মাদ্রাসায় তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে এখনকার ১৪ বছরের আদুরী। অভাবের তাড়নায় গৃহকর্মীর কাজে না গেলে হয়তো আরো ২/১ শ্রেণি এগিয়ে থাকতো। তবে তা নিয়ে চিন্তা নেই তার। শুধুই পড়ালেখা চালিয়ে যেতে চায় আদুরী।

সরেজমিনে গ্রামের বাড়িতে গেলে আদুরী বাংলানিউজকে বলে, ‘ইচ্ছা আছিলো স্কুলে পড়ার, কিন্তু পারি নাই। তারপরে গেলাম জৈনকাঠি সালেহিয়া দাখিল মাদ্রাসায়। এহন মাদ্রাসায় পড়তে বেশ ভালো লাগে। সবাই ভালো পায় আমারে’।

‘সকালে মাদ্রাসায় যাই, ক্লাস শ্যাষ অইলে বাড়ি আই। বাড়ি আইয়া বাছুর গরুডার খোঁজ-খবরও রাহি। সময় মতো পড়তে বই। এ্যাছাড়া কোনো কাম-কাইজ নাই। ভাবি (বড় ভাইর স্ত্রী) আর মায়ই তো সংসারের সব কাম করেন’।

পরিবারও সব সময় পাশে রয়েছে নির্যাতিতা মেয়েটির।  ছবি: বাংলানিউজভবিষ্যৎ ইচ্ছের কথা বলতেই মাথা নিচু করে দাড়িয়ে থেকে আদুরী বলে, ‘লেখাপড়া কইরা লই’।

তার কথায় সায় দিয়ে বড় ভাই সোহেলের স্ত্রী নিশু বলেন, ‘এহনো কি অর বুঝের বয়স অইচে। ও তো পোলাপানের লগে এহনো ঘুরে, বই পড়ে আর বাছুর গরু আছে, এটা হেইডা লইয়্যা তালে-যন্ত্রণায় থাহে’।

আদুরীর মা সাফিয়া বেগম বলেন, ‘শরীরে কতো কষ্ট, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় যে শক্ত হইয়া গেছে। অপারেশন করা লাগতো, কিন্তু টাহা কই? এহন তো চুলকায়ও। হেইয়ার পরও মাদ্রাসায় যায়, পড়ালেখা করে’।

বড় ভাই সোহেল মৃধা বলেন, ‘আমি পড়তে পারি নায়, একদিন স্কুলের বারান্দায়ও যাই নাই। ও তো পড়তে চায়, তাই ওর পড়া ছাড়া কোনো কামই নাই। অভাবের তাড়নায় কর্মে দিয়া অনেক তো কষ্ট সইছে, এহন না হয় ওর ইচ্ছার কথাই শুনি’।

তিনি বলেন, ‘আদুরীরে পুলিশের স্যারেরা ২ কাডা জায়গা কিইন্যা দিছেন। হেইয়ার লগে ২ কাডা আমি কিইন্যা কোনোরহম একটা ঘর উডাইয়া এহন থাহা শুরু করছি। যার লইগ্যা মাথা গুজুম কোথায়, হেইয়ার চিন্তা আদুরীরও  নাই আমারও নাই। তয় বাবার পয়লা ঘরের সন্তানগো নানা (শ্বশুর) বাড়ির জায়গায় একটা ঘর আছে। হেইহানেও আমরা থাহি। তবে হেই ঘরডার জায়গা অল্প দিনেই খালি কইরা দিতে হইবে। কয়দিন আর মানষে থাকতে দেবে?’

‘আদুরীরে পুলিশ স্যারেরা যে ৫টা রিকশা দিছিলেন, হেইগুলা নষ্ট হইয়া যাইতেছিলো। তাই ৪ডা বেইচ্চা দিয়া আল্লাহরাস্তে পাওয়া গরুর লাইগ্যা খর কিনছি। হেইয়ার বাছুর গরুডা আদুরীই পালে। যেডা একদিন আয়ের উৎস অইবো। আর রিকশা একটা এহনো কৈরখালী বাজারে পইরা রইসে কেউ কিনতেও চায়না। তয় একটা অটোরিকশা যদি স্যারেরা দিতেন, তবে হেইডা কামে লাগতো। তারপরও যতো কষ্ট হউক, আদুরী চাইলে পড়বে’।

এখনো নির্যাতনের ক্ষতচিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে, তারপরও পড়ায় মনোযোগী আদুরী।  ছবি: বাংলানিউজআদুরীকে নির্যাতনের ঘটনায় ঢাকার পল্লবী থানায় মামলা করেন তার মামা নজরুল চোধুরী। এ মামলায় গৃহকর্ত্রী নওরীন জাহান নদী ও তার মা ইসরাত জাহানের বিচার শেষ হয়েছে। আগামী ১৮ জুলাই রায় দেবেন ঢাকার ৩নং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক জয়শ্রী সমাদ্দার। নদী কারাগারে আটক থাকলেও জামিনে আছেন তার মা ইসরাত।

নদী ও তার মায়ের উপযুক্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও চায় আদুরীর পরিবার।  

বাংলা‌দেশ সময়: ২০২০ ঘণ্টা, জুলাই ১৩, ২০১৭
এমএস/এএসআর

** আগুনের ছ্যাঁকায় ক্ষত জিহবায় কথাও আটকে যাচ্ছে আদুরীর
** এখনো ক্ষত-যন্ত্রণা বয়ে চলেছে আদুরী
** ‘আমি নদীর ফাঁসি চাই’

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।