ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

এখনো ক্ষত-যন্ত্রণা বয়ে চলেছে আদুরী

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০২৬ ঘণ্টা, জুলাই ১৩, ২০১৭
এখনো ক্ষত-যন্ত্রণা বয়ে চলেছে আদুরী পরিবারের সঙ্গে থেকে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখছে আদুরী। ছবি: বাংলানিউজ

পটুয়াখালী থেকে ফিরে: গত চার বছর ধরে নির্যাতনের ক্ষতচিহ্ন আর শারীরিক যন্ত্রণা বয়ে নিয়ে চলেছে আদুরী। শরীরজুড়ে থাকা ক্ষতচিহ্নগুলোর অনেক স্থানেই শক্ত টিউমারের মতো হয়ে গেছে। রাতের বেলার যন্ত্রণা আর চুলকানিই এখন তার নিত্যসঙ্গী।

তারপরও সুন্দর একটি ভবিষ্যতের আশায় এগিয়ে চলেছে মাদ্রাসার তৃতীয় শ্রেণির পড়ুয়া আদুরী।

অল্প বয়সে বাবাকে হারানোর পর অভাবের কারণে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে পটুয়াখালীর বাড়ি থেকে ঢাকায় যাওয়া আদুরী গৃহকর্ত্রী নওরীন জাহান নদীর হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার।

সে সময়কার ১১ বছরের আদুরীকে মারধর, গরম ইস্ত্রি, খুন্তি, চামচ বা তেলের ছ্যাঁকা, ব্লেড দিয়ে শরীর পোঁচানো, মাথায় কোপ, মুখে আগুনের ছ্যাঁকা, খেতে না দেওয়াসহ ভয়াবহ সব নির্যাতন চালানোর পর মৃত ভেবে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিলেন নদী।

২০১৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানীর বারিধারা ও ডিওএইচএস তেলের ডিপোর মাঝামাঝি রেললাইন সংলগ্ন ওই ডাস্টবিনের পাশ থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয় কঙ্কালসার ও মৃতপ্রায় শিশু গৃহকর্মী আদুরীকে। উদ্ধারের সময় তার শরীরে ছিলো অসংখ্য নির্যাতনের চিহ্ন।
 
এখনো নির্যাতনের ক্ষত-যন্ত্রণা বয়ে চলেছে আদুরী।  ছবি: বাংলানিউজঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে প্রায় দেড় মাসের চিকিৎসার পর ক্ষতচিহ্ন নিয়ে মা আর ভাই-বোনদের সঙ্গে থাকতেই পটুয়াখালী সদর উপজেলার জৈনকাঠি ইউনিয়নের পূর্ব জৈনকাঠি গ্রামে চলে আসে আদুরী।

অভাব আর ধার-দেনা জর্জরিত বড় ভাই মো. সোহেল মৃধার সংসারে বাবাহীন ১৪ বছরের আদুরী এখনো অসহায়।   তবে ভাইও নিজের আর বাবার রেখে যাওয়া সংসার মিলিয়ে ৯ সদস্যের জন্য সাধ্যের সবকিছুই করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

ভাইয়ের স্নেহ-ছায়ায়ই পড়াশোনা চালিয়ে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে আদুরী। যন্ত্রণা সত্ত্বেও বিনয়ী চালচলন, শৈশবের চপলতা ও মুখের হাসি দিয়ে এ স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে চলেছে সে।

সরেজমিনে আদুরীর বাড়িতে গেলে বাংলানিউজকে সে বলে, ‘নিজেরে যহন নিজে দেহি, তহন তো খালি দাগই দেহি। এহন খালি ব্যাতা করে আর চুলকায়, শরীলের বিভিন্ন জায়গা শক্ত হইয়া গ্যাছে’।
 
বড় ভাই সোহেল মৃধা বাংলানিউজকে জানান, আদুরী মাদ্রাসায় পড়াশোনা করছে। পরিবারের সঙ্গে বেশ ভালোই আছে। শুধু ক্ষতচিহ্নগুলোই পেছনের কোনো স্মৃতি মুছতে দিচ্ছে না। বিভিন্ন স্থানে ক্ষতচিহ্নজুড়ে শক্ত টিউমারের মতো হয়ে গেছে। রাতের বেলা ওইসব জায়গায় চুলকানি হয়। অনেক রাত তো ঘুমাতেও পারে না। এজন্য ডাক্তার দেখাতে হবে। কিন্তু অর্থের অভাবে তাও হয়ে উঠছে না।

তিনি বলেন, ‘আমি নদীতে মাছ ধরি, সুদে টাহা লইয়া জাল বুনছি। মাছ বেইচ্চা যে টাহা হয়, তা দিয়া মা, ৪ ভাই-বুইন নিজের বউ ও দুই সন্তান লইয়া কোনোরহম দিন কাডাই। আদুরীর এহন চিকিৎসার প্রয়োজন অইলেও তা করাইতে পারতাছি না। নিজের পোলা দ্বীন ইসলামও শারীরিক প্রতিবন্ধী। তার প্রতিবন্ধী কার্ড আইজ পর্যন্ত করাইতে পারি নাই। একটা বোনের বাচ্চা হইছে, টাহার লাইগ্যা হেইয়া দ্যাখতে যাইতেও পারি নাই’।

আদুরীর মা সাফিয়া বেগম বলেন, ‘যতোই অভাব-অনটন থাউক, আইজ মাইয়াডার দশা এইরহম অইবে হ্যা বোঝলে কামে দেতাম না। এই যে গত কয়দিন ধইরা মাইয়াডার জ্বর অইছে। পোলাডায় নিয়া ডাক্তার দেহাইয়া ঔষধ আনছে। এই টাহার যোগানই বা কেডা দেয় এহন?’

‘হেইয়ার পরও শান্তি- মাইয়াডায় চোখখের সামনে আছে, মাদ্রাসায় যায়, বাড়ির পোলাপানের লগে ঘোরাঘুরি করে, খরের (গোয়াল) গরুডারে নিজের মতো কইরা পালে। মইরা গ্যালে এও তো দ্যাখতে পারতাম না’।

জরাজীর্ণ বাড়ি।  ছবি: বাংলানিউজআদুরীকে নির্যাতনের ঘটনায় ঢাকার পল্লবী থানায় মামলা করেন তার মামা নজরুল চোধুরী। এ মামলায় গৃহকর্ত্রী নওরীন জাহান নদী ও তার মা ইসরাত জাহানের বিচার শেষ হয়েছে। আগামী ১৮ জুলাই রায় দেবেন ঢাকার ৩নং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক জয়শ্রী সমাদ্দার। নদী কারাগারে আটক থাকলেও জামিনে আছেন তার মা ইসরাত।

নদী ও তার মায়ের উপযুক্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও চায় আদুরীর পরিবার।  

বাংলা‌দেশ সময়: ১৬২০ ঘণ্টা, জুলাই ১৩, ২০১৭
এমএস/এএসআর
**
‘আমি নদীর ফাঁসি চাই’

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।