ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

‘আমি নদীর ফাঁসি চাই’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৩০ ঘণ্টা, জুলাই ১৩, ২০১৭
‘আমি নদীর ফাঁসি চাই’ এখনো ব্যথায় কোকায়, কথা বলতে কষ্ট হয় আদুরীর,ছবি: মুশফিক সৌরভ

ঢাকা: বাবা-মা অনেক আদর করেই মেয়েটির নাম রেখেছিলেন আদুরী! অল্প বয়সে বাবাকে হারানোর পর অন্যের বাসায় কাজ করতে হতো তাকে। দিন-রাত কাজ করে আদরতো দূরের কথা, জুটতো গরম ইস্ত্রি, খুন্তি, চামচ বা তেলের ছ্যাঁকা। মারধর, ব্লেড দিয়ে শরীর পোঁচানো, মাথায় কোপ, মুখে আগুনের ছ্যাঁকা, খেতে না দেওয়াও বাদ যায়নি নির্যাতনের তালিকা থেকে।

চার বছর আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বাংলানিউজের কাছে আঁতকে ওঠার মতো সেইসব নির্মম নির্যাতনের কথা বর্ণনা করেছিলো আদুরী।

২০১৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর বারিধারা ও ডিওএইচএস তেলের ডিপোর মাঝামাঝি রেললাইন সংলগ্ন ডাস্টবিন থেকে উদ্ধার করা হয় ১১ বছরের শিশুটিকে।

নির্যাতন চালিয়ে মৃত ভেবে সেখানে ফেলে দিয়েছিলেন তার গৃহকর্ত্রী নওরীন জাহান নদী।

অচেতন অবস্থায় কঙ্কালসার ও মৃতপ্রায় গৃহকর্মী আদুরীকে উদ্ধার করে সন্ধ্যার পর ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে আসেন এক নারী ও ক্যান্টনমেন্ট থানা পুলিশ।

উদ্ধারের সময় তার শরীরে ছিলো অসংখ্য নির্যাতনের চিহ্ন। মাথাসহ শরীরের সব জায়গাতেই পুরনো আঘাতের দাগ ও ঘাও পাওয়া যায়। তখন শিশু আদুরীর কথা বলা তো দূরের কথা, উঠে বসার শক্তিও ছিলো না। পরনে ছিলো শুধু একটি ময়লা লাল পাতলা কাপড়ের হাফপ্যান্ট।

অর্ধ কঙ্কাল অবস্থায় ডাস্টবিন থেকে উদ্ধার হওয়া আদুরীকে নিয়ে সে সময় একের পর এক সংবাদ হতে থাকে গণমাধ্যমে।  

উদ্ধারের পর হাসপাতালে মুমূর্ষু আদুরী (ফাইল ফটো)ঢামেক হাসপাতালের তৎকালীন পরিচালক ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমানের নির্দেশে মেডিকেল বোর্ড গঠন করে ঢামেক হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) আদুরীর চিকিৎসা দেওয়া হয়।

প্রায় দেড় মাস চিকিৎসার পর যখন আদুরীকে রিলিজ দেওয়া হয়, তখনও সে ভালোভাবে কথা বলতে পারতো না। শরীর ছিলো প্রচণ্ড দুর্বল।

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে ওই বছরের ০৭ নভেম্বর আদুরী চলে যায় নিজ বাড়ি পটুয়াখালী জেলার জৈনকাঠি ইউনিয়নের নিজ গ্রাম কৈরখালিতে। সেখানে মা সাফিয়া বেগম ও তার ভাই-বোনদের সঙ্গে বসবাস করছে বর্তমানে ১৫ বছরের আদুরী।

ঘটনার তিনদিন পর একই বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর পল্লবী থানায় গৃহকর্ত্রী নওরীন জাহান নদী, তার স্বামী সাইফুল ইসলাম মাসুদ, মাসুদের দুলাভাই চুন্নু মীর ও তাদের আত্মীয় রনিকে আসামি করে পল্লবী থানায় মামলা করেন আদুরীর মামা নজরুল চোধুরী।

তবে পুলিশি তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় চার্জশিট থেকে মাসুদ, চুন্নু মীর ও রনিকে বাদ দেওয়া হয়। তদন্তে নদীর মা ইসরাত জাহানের সম্পৃক্ততা পাওয়ায় নতুন করে তাকে আসামি করা হয়।

এ মামলার রায় দেওয়া হবে আগামী ১৮ জুলাই। ঢাকার ৩নং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক জয়শ্রী সমাদ্দার রায়টি দেবেন।      

মোবাইলে বাংলানিউজের সঙ্গে কথা হয় আদুরীর। মামলার রায়ের কথা শুনে এক কথায় জবাব দেয় মেয়েটি। বলে, ‘আমি নদীর ফাঁসি চাই’।

গ্রামের মাদ্রাসায় পড়ছে আদুরী। সারাদিন পড়াশোনা ও খেলাধুলা করে সময় কেটে যাচ্ছে। তবে নদীর দেওয়া আঘাত শরীরে এখনও ভোগাচ্ছে তাকে। ইস্ত্রি ও খুন্তি দিয়ে ছ্যাঁকা দেওয়া জায়গাগুলোতে ব্যথা করে বলে জানায়। এমনকি জিহবায় আগুনের ছ্যাঁকা দেওয়ায় কথা বলতেও কষ্ট হয় আদুরীর।

মামলার দিনই ২৬ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করা হয় নদীকে। সেই থেকে কারাগারে আটক আছেন তিনি। জামিনে আছেন তার মা ইসরাত জাহান।

গ্রেফতারের পর ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদুরীকে নির্যাতনের কথা স্বীকার করে ওই বছরের ০১ অক্টোবর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন নদী। আদুরীও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ২২ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দেয়।

একই বছরের ১০ অক্টোবর গৃহকর্ত্রী নওরীন জাহান নদী ও তার মা ইসরাত জাহানকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দেন পুলিশের নারী সহায়তা ও তদন্ত বিভাগের এসআই কুইন আক্তার। চার্জশিটের সঙ্গে যেসব জিনিস দিয়ে আদুরীকে ছ্যাঁকা দেওয়া হতো, সেগুলোর তালিকাও দেন তিনি। জব্দ করা জিনিসের মধ্যে রয়েছে পুরনো ইস্ত্রি ও খুন্তি।

২০১৪ সালের ০৬ জুন আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করে বিচার শুরু করেন আদালত।

এ মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ ১৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করেছেন আদালত। উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপন শেষ হয় গত ০৯ জুলাই।

চার্জশিটের পাতায় পাতায় আদুরীকে নির্যাতনের ভয়াবহ বর্ণনানির্যাতিত আদুরীর পক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির অ্যাডভোকেট ফাহমিদা আক্তার রিংকি। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীরা অভিযুক্ত আসামিদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন। আমরা সঠিক রায় প্রত্যাশা করছি’।

১৮ জুলাই রায়ের দিন নদীকে ঢাকায় আনার চেষ্টা করা হবে বলেও জানান তিনি।

মামলার বাদী নজরুল চৌধুরীও তার ভাগ্নি আদুরীকে নির্যাতনের উপযুক্ত শাস্তি প্রত্যাশা করেন।

বাংলাদেশ সময়: ১১২০ ঘণ্টা, জুলাই ১৩, ২০১৭
এমআই/ এজেডএস/এসও/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।