তিন বা চার পলিথিন শশা বিক্রি হওয়াতে খুশি বিক্রেতা। পরের স্টপেজে পৌছার ফাঁকে বাসের ইঞ্জিনের ওপর বনেটে বসলেন।
এছাড়াও একটু পরপর সিগারেট ধরিয়ে দিতে আর পান দিতে ব্যস্ত থাকেন সুপারভাইজার। হেলপারও বাসের বাম পাশ থেকে সামনের রাস্তায় 'খাড়া' আর 'ডাবল ডাবল' শব্দগুলো বলে পথের বর্ণনা দিচ্ছেন। হেলপার আর সুপারভাইজররা বাসের ড্রাইভারদের যে মাত্রায় ভক্তি করেন, আর কোন পেশায় এতো অনুগত শীষ্য মেলা ভার। দু’একটা বেয়াদব অবশ্য বিভিন্ন সময়ে দেখা যায়, যারা ওস্তাদের চেয়ে বেশি বোঝে!
তবে এদের এই তিনজনের সমন্বয়টা বাস শ্রমিকদের বেশিরভাগের মতোই মধুর। যাত্রীর চাপ কম থাকায় হেলেদুলে যাচ্ছে বাস। যাত্রীদের দু’একজন বাস টানার জন্যে বললে, নেমে যাওয়ার পথ দেখিয়ে দেন তারা। আমার ঘাড়টায়ও যে হাত পড়ে নাই সেটা একটা 'মানির মান আল্লাহ রাখে’র মতো মনে হলো।
ঢাকার সঙ্গে লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলায় যাতায়াতের জন্য বছর ছয়েক অাগেও বেশ জনপ্রিয় বাস ছিল অাল অারাফাহ। নোয়াখালীর সোনাইমুড়ির বদলে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ সড়ক ব্যবহার করায় ঢাকার সঙ্গে দূরত্ব প্রায় এক ঘণ্টা কমে যায়। আর এটি রামগঞ্জ উপজেলা ছাড়িয়ে দক্ষিণে আরো ৭ কিলোমিটার দূরে পানপাড়া বাজার পর্যন্ত যায়। তবে হাজীগঞ্জ হয়ে রামগঞ্জ রুটে বাস সেবায় মনোপলি হয়ে পড়ার কারণে এই কোম্পানির বাস সেবায় সঙ্গী হয়েছে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, লক্কড় ঝক্কর বাস, ড্রাইভার, হেলপারদের স্বেচ্ছাচারিতা।
ফলে মানুষ এখন পথের দূরত্ব বেশি হলেও আবারো সোনাইমুড়ির পথ ব্যবহার করছেন সময় কম লাগে বলে। কারণ কাউন্টার সার্ভিসের মাধ্যমে শুরু হওয়া আল অারাফাহ এখন পুরোপুরি লোকাল বাস হিসেবে চলছে এবং বাসগুলোর বডি বা ভেতরে কোন সংস্কারও নেই।
এসব অভিযোগ অামারও জানা ছিল, তবে বাড়ির কাছ থেকে ওঠা যায় বলে এবার তাতেই যাত্রী হলাম। আর ফাঁকা রাস্তায় অন্য সময়ের তুলনায় কিছুটা ভাল চলবে বলেই অাশা করেছিলাম।
৫২ সিটের বাসটায় ঢাকা যাওয়ার যাত্রী সব মিলিয়ে হবে ১৫ জনের মতো। কিন্তু বেশিরভাগ যাত্রী কাউন্টারের বদলে রাস্তার পাশ থেকে ওঠানো হয়েছে। কাউন্টারে টিকিটের দাম ৩০০ টাকা হলেও হেলপার টেনে ওঠালে যাত্রী সংকটের দিনে ভাড়াটাও ৫০ টাকা কম হয়। বাসে বেশিরভাগই লোকাল দূরত্বের যাত্রী। অবশ্য মোবাইলে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বারবারই ঢাকার জন্য মাত্র ৯ জন যাত্রীর হিসেব দিয়ে যাচ্ছেন সুপারভাইজার। বাস সার্ভিস লাটে ওঠার বড় কারণ বোঝা গেলো।
হাজীগঞ্জের পরে অার টিকিট কাউন্টার না থাকলেও কুমিল্লার মুদাফফরগঞ্জ বাজারে সিএনজি অটোরিকশা স্ট্যান্ডের সামনে আবারো ঘাঁটি গাড়ে বাসটি। চালকের হাবভাব বলছে, অন্তত ১৫ মিনিটের অাগে তিনি নড়বেন না। হেলপার-সুপারভাইজর নেমেই হাঁকডাক শুরু করলেন। শুধু স্ট্যান্ড নয়, রাস্তায় চলন্ত অটোরিকশা থেকেও যেন যে কোন গন্তব্যের যাত্রীদের নিজেদের রুটে নিয়ে যাওয়াটা ইচ্ছে তাদের।
অামি জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম। একজন অসুস্থ নারীসহ তিনজন যাত্রীর গন্তব্য কুমিল্লা শুনতেই তাদের হাতের ব্যাগ নিয়ে বাসে উঠে গেলেন সুপারভাইজর, যেনো কোনভাবেই যাত্রী মিস না হয়। সঙ্গে জানাতে ভুললেন না যে, পুরো বাসই খালি। তবে বাসে উঠতেই বোঝা গেলো আসলে দুটি পাশাপাশি সিট কোথাও খালি নেই। আর রোগিনীর যে অবস্থা তাতে না শুয়ে যেতে পারবেন না। রোগিনীর সংকটজনক অবস্থা দেখে সিট ব্যবস্থা করার বদলে তাড়াতাড়ি করে বাস থেকে ব্যাগ নামিয়ে দিলেন সুপারভাইজর।
অসুস্থ নারীর স্বামী অনেক অনুনয় বিনয় করলেও লাভ হলো না। বাসে যাত্রীদের অনেকেই সিট ছেড়ে দিয়ে রোগিনীর শোয়ার জায়গা করে দিতে অাগ্রহ দেখালেন। অনেকেই চালক ও সুপারভাইজরকে এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করলেন। তবে রোগিনী এবং তার স্বজনদের বাস থেকে নামিয়ে দিলেন সুপারভাইজর।
অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ জানানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করা বা উস্কে দেয়া একটা কৌশল। তবে ড্রাইভাররা সাধারণত এসব কথা কানে নেয় না। এখানেও যাত্রীদের উস্কে দিতে কয়েকটা কথা বললাম। ভৎর্সনা দিয়ে একটু গলা চড়িয়ে ড্রাইভারের কাছে জানতে চাইলাম, আপনের সুপারভাইজর রোগীকে নামালো কেন? গাড়িতে উঠানোর অাগে দেখে নাই!'
যাত্রীদের অনেকেরই এই প্রশ্ন। অবশ্য ড্রাইভার ডান দিকের জানালা দিয়ে তাকিয়ে অাছেন নির্লিপ্তভাবে। হঠাৎ হঠাৎ যেন এ জগতে অাসেন, তখনই জানালা দিয়ে মাথা বের করে 'ঢাকা ঢাকা' বলে ৪ থেকে ৬ বার ডাক দেন।
আবারো গলা উঁচু করে বলি, সাড়ে চার ঘণ্টায়তো ৮০ কিলোমিটার রাস্তা পার হননি! আজ কি ঢাকা পৌছাবো? আপনার গাড়ি চালানোর ধরন দেখে মনে পড়ছে ঢাকায় ১৩ নাম্বার বাসের কথা। "
এবার কাজ হলো, তবে বুমেরাং! ড্রাইভার মাথার ওপরের লুকিং গ্লাস দিয়া আমার দিকে তাকালেন। চোখে চোখ পড়লো। সুপারভাইজরকে বললেন, 'উনারে নামাইয়া দে। উনার তাড়া বেশি। আর চার ঘণ্টা, চার ঘণ্টা করতেছে খালি। অন্য যাত্রীদেরও ক্ষেপাইয়া তুলতেছে এগুলা বলে। '
দ্বিতীয় সারির সিটে বসায় চালকের নির্দেশনা শুনতে পেলাম। এতোক্ষণ যারা কথা বলছিলেন, তাদেরও অনেকে চুপ হয়ে গেলেন। কারণ এখন যদি এখানে নামিয়ে দেয় তবে ঢাকায় পৌছানো আরেক ঝক্কি। আর পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে ঝামেলা করার ফল পেতে হলে সায়েদাবাদ টারমিনাল যেতে হবে না, তার অাগে অনেক স্ট্যান্ড রয়েছে। ভাড়াও দেয়া হয়ে গিয়েছে। আর এখন বেশিরভাগ যাত্রীই জরুরি কাছে ঢাকা ফিরছেন।
ওস্তাদ সম্বোধন করে তখনই চালককে বললাম, ভাই ভুল হয়ে গেছে। বাকি দূরত্বে আর একটি কথাও বলবো না।
সুপারভাইজর সিগারেট ধরিয়ে দিয়ে গেলেন চালকের হাতে।
এদিকে অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে স্বামী যে পরিবহন যোগাড় করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন, সেটা দেখা গেলো জানালা দিয়েই। শারীরিকভাবে এতো দূর্বল রোগীকে নিতে চাইছে না কেউই। সেখানেই সিএনজি স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা প্রায় ২০ জন চালকের কেউই রাজি হলো না। রোদের মধ্যে ঘামছেন অার স্ত্রীকে নিয়ে গাড়ি খুঁজছেন ওই ব্যক্তি। জানালা দিয়ে মুখ বের করে জানতে চাইলাম, মাইক্রোবাস পাওয়া যায় না? বা মাইক্রো ড্রাইভারদের কারো নাম্বার নাই? পুরুষটি উত্তর দিলেন, 'ভাড়া অনেক বেশি চায়!'
কত? জানতে চাইলে উত্তর দেন, '৫ হাজার টাকা। '
এবার অামি একটু তাজ্জব বনে গেলাম! চোখের অনুমানে ২৩ থেকে ২৫ বছর বয়সী অসুস্থ মেয়েটির হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছে। ব্যথা কমাতে বা শরীরের ভার রাখতে তলপেট শক্ত করে দু'হাত দিয়ে চেপে রেখেছেন। স্বামীর শরীরে ভর দিয়ে পা ঘঁষে ঘঁষে চলছেন।
আমরাও চলেছি রাজধানীর পথে। পথ যতো এগুবে, ততোই স্মৃতির আড়ালে চাপ পড়ে যাবে ওই অসুস্থ নারী ও তার স্বামীর অসহায়ত্ব।
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৫ ঘণ্টা, জুন ২৮, ২০১৭
এমএন/জেডএম