ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

ইটের মধ্যে থেকে মানুষ কীট হয়ে যাচ্ছে!

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৭ ঘণ্টা, জুন ২৭, ২০১৭
ইটের মধ্যে থেকে মানুষ কীট হয়ে যাচ্ছে! বোটানিক্যাল গার্ডেনে আগত দর্শনার্থীরা/ছবি: জিএম মুজিবুর, ভিডিও: সেরাজুল ইসলাম সিরাজ

ন্যাশনাল বোটানিক্যাল গার্ডেন ঘুরে: বিশাল এলাকাজুড়ে অবস্থিত ন্যাশনাল বোটানিক্যাল গার্ডেনে দর্শনার্থীর কমতি নেই। উদ্ভিদ প্রজাতি সংরক্ষণ, গবেষণা ও প্রদর্শনে প্রয়োজনেই এই উদ্যান স্থাপিত হলেও সেখানে গবেষণা ও তথ্যের প্রয়োজনে খুব কম লোকই আসেন। ইট-কংক্রিটের শহরে হাঁসফাঁস করা মানুষেরা বোটানিক্যাল গার্ডেনে আসেন নির্মল বাতাসে বুকভরে শ্বাস নিতে।

বোটানিক্যাল গার্ডেনে এসে শিশুরা যেমন উদ্ভিদ প্রজাতির বিষয়ে জানার চেষ্টা করছে না তেমনি তাদের অভিভাবকরাও সন্তানদের কিছুই শেখানোর চেষ্টা করেন না। আবার শেখার ইচ্ছা থাকলেও খুব একটা সুযোগ নেই বলে অভিযোগ করেছেন অনেকে।



২০৮ একর জায়গায় প্রতিষ্ঠিত উদ্যানটিতে রয়েছে ৬৮ হাজার উদ্ভিদের বিশাল ভাণ্ডার। কিন্তু খুব কম সংখ্যক গাছেই নামফলক দেখা যাবে। যে কারণে কোনো গাছ দেখে নাম জানার আগ্রহ তৈরি হলেও তার সুযোগ নেই বলে দাবি করেছেন দর্শনার্থীরা। বোটানিক্যাল গার্ডেনে আগত শিক্ষার্থী নাঈম শিকদাররাজউক কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র নাঈম শিকদার ঘুরতে এসেছেন দাদার সঙ্গে। প্রথমবার এসেই উদ্যানটি তার বেশ ভালো লেগেছে। গাছপালা ভালো লাগে তাই এখানে ঘুরতে এসেছেন। তার পাশেই থাকা কয়েকটি গাছের নাম জানতে চাওয়া হলে মাথা ঝাঁকিয়ে জানায় নাম না জানার কথা। ঢাকা শহরে ইটের মধ্যে থাকতে থাকতে মানুষ কীট হয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করে রাজউক কলেজের ওই শিক্ষার্থী।

কথা হয় সিরাজুদ্দিন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের (টঙ্গী) সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সামছুজ্জামানের সঙ্গে। সেও অকপটে স্বীকার করে গাছ না চেনার কথা। সারাদিন ঘরে মধ্যে থাকতে তার ভালো লাগে না। ঈদের ছুটি পেয়ে তাই গাছের কাছাকাছি এসেছে বলে জানায় সে।

বোটানিক্যাল গার্ডেনের কাছেই মিরপুর-৭ নম্বরে থাকেন ব্যবসায়ী বজলুল হক। প্রথমবার সপরিবারে এসেছেন বোটানিক্যাল গার্ডেনে। বড় মেয়ে তানহা পড়েন মিরপুর বাংলা স্কুলের চতুর্থ শ্রেণিতে। বজলুল হক পরিবার তখন বোটানিক্যাল গার্ডেন দেখা শেষে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন।
 
তানহার কাছে প্রশ্ন ছিল, কী দেখতে এসেছো? জবাব দিলো, এখানে বাঘ-সিংহ দেখতে এসেছি। জানালো গাছ ভালো লাগে তবে তার কোনো গাছ চেনা নেই।

তানহার বাবা বজলুল হক সরল স্বীকারোক্তি দেন, আমিই চিনিনা মেয়েকে কী চেনাবো! অনেক গাছ রয়েছে, যেগুলো জীবনে প্রথম দেখলাম, নাম জানব কী করে? অল্প সংখ্যাক গাছে নামফলক দেওয়া আছে। পায়ে হাঁটার পথের পাশের গাছগুলোতে যদি নামফলক দেওয়া থাকতো তাহলে বাচ্চারা শেখার সুযোগ পেতো।
বোটানিক্যাল গার্ডেনে আগত শিক্ষার্থী তানহা১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই উদ্যানে শাপলা পুকুর, পদ্ম পুকুরসহ ছোটবড় জলাশয় ৯টি, অর্কিড ঘর, ক্যাকটাস ঘর, মৌসুমী ফুলের বাগান ২টি, তিনশ প্রজাতির গোলাপ ফুলের বাগান ছাড়াও রয়েছে বিশাল লেক।
 
দেশি ৩৪৫ প্রজাতির উদ্ভিদ, বিদেশি ৬৬৫ প্রজাতির উদ্ভিদ আছে বোটানিক্যাল গার্ডেনে। এছাড়াও একটি আন্তর্জাতিক উদ্যান, যেখানে বিভিন্ন দেশের বৃক্ষের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে।

পঞ্চান্ন বছর বয়সী উদ্ভিদ উদ্যানটিতে বিশাল বিশাল গাছের সমারোহ। মূল ফটক থেকে ভেতরে ঢুকতেই হাতের ডানে পড়বে বিশাল লেক যার চারদিকে নানান বৃক্ষের সমারোহ। এক সময় এই লেকের পানি ছিল স্বচ্ছ। কিন্তু এখন ময়লা আবর্জনা ফেলে দূষিত করে ফেলা হচ্ছে।

পুরো লেকজুড়ে ছোট কচুরিপানার সঙ্গে ভাসছে প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিন, বিস্কুটের ঠোঙা, সিগারেট ও দিয়াশলাইয়ের খালি প্যাকেট, কী নেই সেখানে! পানির রঙের কথা বলাই বাহুল্য।
বোটানিক্যাল গার্ডেনে ধুমপান করা ও বিক্রি নিষেধ হলেও তা মানা হচ্ছে না মোটেইপুরো উদ্যানে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে হরেক পণ্যের হকাররা। খাবারের পাশাপাশি বিভিন্ন মনোহরি পণ্যের পসরা নিয়ে এসেছে তারা। সিগারেট বিক্রি হচ্ছে ধুমছে। আর সেই সিগারেটে ফু দিতে দিতে পুরো এলাকা চক্কর দিচ্ছেন অবিবেচক দর্শনার্থী ও বখাটেরা।

দুপুরে মূল ফটকের পঞ্চাশ গজ ভেতরে দেখা হয় সিগারেট বিক্রেতা স্বপনের সঙ্গে। তিনি নিজেও একের পর এক সুখ টান দিয়ে যাচ্ছিলেন। তার কাছে প্রশ্ন ছিল, এখানে তো সিগারেট খাওয়া এবং বিক্রি নিষেধ।

দরাজ গলায় জবাব দিলেন আমি কোম্পানির লোক। কোন কোম্পানি, কীসের কোম্পানি সে বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, দেখছেন না ব্যস্ত আছি? পরে আসেন।
 
তার সঙ্গে যখন কথা হয়, তখন পাশ দিয়ে একটি পুলিশের গাড়ি সাঁই সাঁই করে চলে গেলো। আবার ভেতরে ভয়ানক গতিতে বাইক চালিয়ে ঘুরতে দেখা গেলো কয়েকজন যুবককে। ভাবখানা এমন যেন কোনো কিছুতেই তাদের পরোয়া নেই। পুলিশেরও সেদিকে কোনো নজর আছে বলে মনে হলো না।
ময়লা আবর্জনা পূর্ণ বোটানিক্যাল গার্ডেনের লেক
এ বিষয়ে কেউ কথা বলতে রাজি হননি। গার্ডের সঙ্গে কথা হলে, টিকিট কাউন্টারে যেতে বলেন। সেখানে বসা মোহাম্মদ জয় শেখ বলেন, আজকে এ বিষয়ে কথা বলার সময় নেই। কথা বলতে হলে অন্যদিন আসতে হবে।
 
জয় শেখের কাছে প্রশ্ন ছিল লোক সমাগম কেমন। শুরু করে লুকোচুরি। বলেন, এখনও হিসেব করা হয়নি। তাহলে গতকালের সংখ্যা যদি বলেন, জবাবে দিলেন গতকাল যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা আজকে নেই।

বিকেল ৩টায় তার টেবিলে ২২টি বইয়ের মুড়ি দেখা গেছে। যার একেকটিতে ১’শ করে পাতা রয়েছে। এ রকম ৩টি কাউন্টার চলমান। প্রত্যেকটির সামনে দীর্ঘলাইন। বছরে ১৫ লাখ পর্যন্ত দর্শনার্থী ভিজিট করার রেকর্ড রয়েছে বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৯০৯ ঘণ্টা, জুন ২৭, ২০১৭
এসআই/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।