ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

হাওরে ঈদ-আনন্দ নেই, আছে অথৈ পানি আর চোখের পানি!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৩ ঘণ্টা, জুন ২৫, ২০১৭
হাওরে ঈদ-আনন্দ নেই, আছে অথৈ পানি আর চোখের পানি! হাওরের চারদিকে এখনও শুধু পানি আর পানি। ছবি: বাংলানিউজ

কিশোরগঞ্জ: চারদিকে শুধুই পানি আর পানি। অথৈই পানিতে ভাসছে একেকটি গ্রাম। এই গ্রামগুলোতেই থাকেন হাওরের মানুষ। শত শত বছর এভাবেই যাচ্ছে তাদের জীবন। হাওরের জীব-বৈচিত্র যেনো এক অপার বিস্ময়। এ বিস্ময়ের সাথে এবার যোগ হয়েছে অকাল বন্যা। যে সময়ে বোরো ধান হৃষ্টপুষ্ট হবে ঠিক সেই সময়ে অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে একের পর এক বাঁধ ভেঙ্গে গিয়ে বোরো ফসল তলিয়ে গেছে। শত চেষ্টা করেও ফসল রক্ষা করতে পারেননি কৃষক।

সরকারের কর্তাব্যক্তিসহ জনপ্রতিনিধিরা ফসলহারা এই কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ত্রাণ দিয়েছেন এবং এখনো দিচ্ছেন।

তবে প্রয়োজনের তুলনায় তা নিতান্তই অপ্রতুল। তারপরও এসব ফসলহারা কৃষকরা আশায় বুক বেঁধে আছেন। এ ত্রাণই কি তাদের বাঁচিয়ে রাখবে?-- এ প্রশ্ন তাদের মুখে উচ্চারিত হচ্ছে বার বার।  

বোরো ধান লাগাবেন বলে ১০ হাজার টাকায় এক একর জমি পত্তন নিয়েছিলেন মিঠামইন উপজেলার ইসলামপুর গ্রামের সমত্ত বেগম ও তার অসুস্থ ছেলে শাহ আলম। এই পরিবারে প্রধান ছিলেন হাসেন আলী। তিনি ১৯৯৬ সালে মারা যান। পঁয়তাল্লিশোর্ধ্ব শাহ আলম এখন রোগে-শোকে কাতর। বসত-ভিটা বলতে নিজের কোনো জায়গাই নেই। অন্যের বাড়িতে থাকেন। তা-ও আবার একটা ভাঙাঘরে। এই ভাঙাঘরেই দুইটি ছোট আকারের গরুর সাথে তাদের বসবাস।  

আহাজারি করে সমত্ত বেগম বাংলানিউজকে বলেন, ‘বাবারে এবারের বানের পানিতে আমার সব ধান গেছে। আধাবেলা খেয়ে না খেয়ে থাকি। নিজেরা তো পেট ভরে খেতে পারি না। তাও আবার এই দুইটি অবলা গরুকে নিয়ে পড়েছি মহা বিপদে। কেউ আমাদের দিকে ফিরেও তাকায় না। এবারের ঈদে নতুন কাপড় কে দেবে আমাদের? এমন কাউকে দেখি না আমার সামনে। আমাদের ঈদ নাই। আছে শুধু চোখের পানি।

মিঠামইন উপজেলার হাওরের পাড়ে রয়েছে এরকম শত শত বিপন্ন পরিবার। এদের পাশে আজ কেউ নেই। এই হাওর-জনপদে এমন মানবিক বিপর্যয় চোখে দেখেনি শতবছরেও কেউ। হাওরের বন্যায় সর্বস্ব হারানো এক পরিবার।  ছবি: বাংলানিউজ‘এবার ঈদে জামা কাপড় নাই, বাবায় কিনে দেবে না। বাবার মন খারাপ। ’-- দু:খভরা স্বরে একথা বলে হাওর উপজেলা মিঠামইনের ঘাগরা ইউনিয়নের চমকপুর গ্রামের জামাল উদ্দিনের ছেলে ৯ বছর বয়সী খায়রুল।  খায়রুলদের পরিবারে সদস্য ৬ জন। এবার তাদের মাঝে ঈদ আনন্দ নেই। বরং ঈদ তাদের জন্য আসছে রাজ্যের দু:খ আর হতাশা নিয়ে।  

মিঠামইনের গ্রামের বাড়িতে এসেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের ছাত্র মো. হাবিবুল্লাহ মাসুম। মিঠামইন বাজারের মৌলভীপাড়ায় বসবাস করে তার পরিবার।  

হাবিবুল্লাহ মাসুম বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিবছরই ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে তার পরিবার। এবার ফসলহারা মানুষগুলোর মুখের দিকে চেয়ে আনন্দ নেই তাদেরও পরিবারে।  

এবার হাওরে বোরো ধান তলিয়ে যাওয়ার রেশ পড়েছে সবার মাঝেই। একটু স্বচ্ছল যেসব পরিবার তাদের মনেও নেই ঈদের আগমনীর আনন্দ। হাওরের ইটনা ও অষ্টগ্রাম উপজেলার সব এলাকায়ও চিত্রটা অভিন্ন হতাশা ও বিষাদের।  

মিঠামইন ইউনিয়ন (ইউপি) পরিষদ চেয়ারম্যান মো.শরীফ কামাল বাংলানিউজকে বলেন, ‘হাওরের ফসলহারা মানুষের ঈদ-আনন্দ নেই। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থা হাওরের মানুষকে ত্রাণ সহায়তা দিচ্ছে। এরপরও আগামী ফসল ঘরে ওঠার আগ পর্যন্ত সরকারসহ বিভিন্ন সংস্থা কৃষকের পাশে থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে এমনটাই কামনা করেন তিনি।  

হাওরের চারদিকে এখনও শুধু পানি আর পানি।  ছবি: বাংলানিউজএই উপজেলার কামালপুর গ্রামেরই কৃতী সন্তান, ‘ভাটির শার্দুল’ নামে খ্যাত বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। তাঁরই জ্যেষ্ঠ পুত্র রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক এই এলাকার নির্বাচিত সংসদ সদস্য।  

কিশোরগঞ্জ-৪ (ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম উপজেলা) আসনের সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক বাংলানিউজকে বলেন, ‘সরকারের কাছে ক্ষতিগ্রস্ত হাওর এলাকাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি জানিয়েছি। মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ হাওর এলাকা পরিদর্শন করে গেছেন। পাশাপাশি সরকারের মন্ত্রিরাও ক্ষতিগ্রস্ত হাওর এলাকা পরিদর্শন করেছেন। সরকারের পক্ষ থেকে ত্রাণ-সহায়তা দেয়া হচ্ছে। এছাড়াও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ত্রাণ দিচ্ছে। ’ 

তিনি আরও জানালেন, ব্যক্তিগতভাবে তিনি নিজেও হাওরের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ত্রাণ সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন। এই হাওরবাসীকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসার আহবান জানান তিনি।  

এবার তাদের ঈদুল ফিতর কাটবে নিরানন্দে। প্রতিবছর এই ঈদে বোরো ধান বিক্রি করে তাদের ছেলে-মেয়েদের জন্য নতুন জামা কিনে দিয়েছেন। পিঠা পুলি বানিয়েছেন। কিন্তু এবার ফসল নাই। তাই যেনো অকাল ঢলের আগ্রাসনে বিপন্ন হাওর পাড়ের শতশত গ্রাম নিস্তব্ধ, নিথর। ফসলডোবা এই বিস্তীর্ণ হাওর জনপদে এখন শুধুই বোবা কান্না।

বাংলাদেশ সময়: ২১০২ ঘণ্টা, জুন ২৫, ২০১৭
জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।