সরেজমিনে গিয়ে কথা বলতে চায়ের দোকানটিতে ঢুকে বিস্ময়ের সীমা রইল না। যেটিকে চায়ের দোকান মনে হয়েছিল, সেটি আসলে ঘর।
চায়ের স্টলটিও আলমগীরেরই। রাজধানীর মহাখালীর কড়াইল বস্তির বউবাজার অংশে দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে সংসার তার। ভাড়াটিয়ারও দুই ছেলে-মেয়ে।
অর্থাৎ, একটি ঘরেই দু’টি আলাদা পরিবারের বসবাস। আটজন মানুষ ও একটি চায়ের স্টল- এ অবস্থায় দিন কাটছে তাদের!
মা মারা যাওয়ার পর বাবার সঙ্গে রাগ করে সেই ছোটবেলায় রাজধানীতে চলে আসেন আলমগীর। তার গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামে। প্রায় ২০ বছর ধরে থাকেন এই বউবাজারে। অনেক কষ্টে কিছু টাকা জমিয়ে প্রায় ১০ বছর আগে একটি পজিশন কেনেন।
কড়াইল বস্তির জমি সরকারের। এখানে যারা অনেক আগে জায়গা দখল করেছিলেন, তারা নিজেদের পজিশনটি প্রয়োজনে বিক্রি করেন। এভাবে বস্তির জমির দখল একহাত থেকে অন্যহাতে যায়। আর এটিকেই পজিশন কেনা-বেচা বলেন বস্তিবাসী। অনেকে আবার ঘরসহই পজিশন বিক্রি করেন।
আলমগীরও অনেকের মতোই পজিশন কেনেন। বছর দুই আগে সেখানে দো’তলা টিনের বাড়ি করেন, ১০টি রুম বানিয়ে ভাড়া দেন। আর নিজে নিচের দু’টি কক্ষে বসবাস শুরু করেন। প্রতিটি ঘর ২ হাজার ৫শ’ টাকা করে ভাড়া দিয়ে তিনি মাসে আয় করতেন ২৫ হাজার টাকার মতো। কিন্তু গত মার্চ মাসের আকষ্মিক অগ্নিকাণ্ডে বউবাজারের দুই-তৃতীয়াংশের সঙ্গে তার ঘরটি পুড়ে যায়। পুড়ে যায় নগদ সত্তর হাজার টাকাও। সে সময় বউ-বাচ্চাসহ নিজের পরনের কাপড় ছাড়া আর কিছুই আগুন থেকে রক্ষা পায়নি।
এখন আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে সংগ্রাম করছেন আলমগীর।
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘ঘরের অন্যপাশে যারে থাকতে দিছি, তিনি আগে ভাড়াটিয়া ছিলেন। কিন্তু আমার মতো তিনিও তো নিঃস্ব। তাই ভাড়া নেই না। ঋণ করে আবার ঘর তুললে তাদের আলাদা রুম দিমু। তখন ভাড়া নিমু’।
‘এই যে চায়ের কেটলি, চুলা-কাপ- এসবও ধার করা। তিন হাজার টাকা জোগাড় করে দোকান শুরু করছি। আপাতত এই দিয়েই সংসার চলতাছে। ঈদের আর কোনো মানে নাই। ট্যাকাই নাই’- যোগ করেন তিনি।
আলমগীরের ভাড়াটিয়া রীনা আক্তার। স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করায় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে বউবাজারে আছেন প্রায় ১৭ বছর ধরে। বাসা-বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেন।
রীনা বলেন, ‘আগুনে তো সবই শ্যাষ কইরা দিল। ঘুমাইনর জন্য বালিশ, খেতাও নাই। ঈদে আর কি করমু!’
প্রায় ২০ বছর আগে স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় এসেছিলেন চাঁদপুরের হাইমচরের নূরজাহান বেগম। বয়সের ভারে এখন দু’জনেই ন্যূজ্ব। আগে টিবি গেটের কাছে টুপরিতে থাকতেন। ২০০৪ সালে বউবাজারে একটি রুম কেনেন। তিন ছেলে, এক মেয়ে নিয়ে সংসার তার। তবে বড় দুই ছেলে বিয়ে করে আলাদা থাকেন। মেয়ের ঘরের দুই নাতনিসহ তাদের সংসারে এখন ছয়জন।
নূরজাহান বলেন, ‘পরনের কাপড় ছাড়া কিছুই বাদ যায় নাই। সব শ্যাষ কইরা দিছে আগুনে। ঈদ টিদ আবার কি? খেতা-বালিশ, কিচ্ছু নাই। উপ্রে (ওপরে) তিরপল (ত্রিপল), মাতার নিচে পুটলা দিয়া ঘুমাই’।
আগুনে পুড়ে এমন নিঃস্ব অবস্থায় রয়েছেন প্রায় সকল বউবাজারবাসীই। সরেজমিনে ঘুরে আরও দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি ঘরেই বর্তমানে তিন চারটি করে পরিবার গাদাগাদি করে বসবাস করছে। অথচ তেমন কোনো সহায়তা আসেনি বলেই তাদের অভিযোগ।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪০ ঘণ্টা, জুন ২৫, ২০১৭
ইইউডি/এএসআর