সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, নির্মাণাধীন রৌমারী স্থলবন্দর থেকে ডানে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে রৌমারী উপজেলার ইজলামারী সীমান্তের ব্রিজ। পাহাড়ের পানি নেমে আসে এই ব্রিজ দিয়ে।
সীমান্ত থেকে প্রতিটা গরু নিরাপদ স্থানে আনা পর্যন্ত দেড় হাজার টাকা করে দেয়া হয় এসব কামলাকে। একটি গ্রুপে ১৫ তেকে ২০ জন কামলা এক হয়ে বাঁশের সাহায্যে গরুকে কাঁটাতার পার করেন। এরপর মূল ক্রেতা বা ব্যবসায়ীকে গরু বা গরুগুলো বুঝিয়ে দেন।
গরু পাচারের সময় বিএসএফ—এর গুলিতে বা ভারতীয়দের হামলায় যারা মারা যান তারা বড় ব্যাপারী নন বা অবৈধ গরুর চালানের ক্রেতা মালদার ব্যবসায়ী নন। এরা গরুর কামলা বা সীমান্ত পার করিয়ে গরু আনার বিপজ্জনক ও চরম ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত দিনমজুর।
আর গরু পাচারের মূল হোতা ব্যাপারী বা ব্যবসায়ীরা পর্দার অন্তরালেই থেকে যান সবসময়। পারও পেয়ে যান। গরু পাচারের ব্যবসায় টাকা খাটিয়ে রাতারাতি এরা একেকজন ‘আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ’ বনে যান।
পেটের দায়ে সীমান্তে গরু আনার অবৈধ কাজ করতে গিয়ে বিএসএফ-এর গুলিতে বা নানারকম অত্যাচার নির্যাতনে প্রায় প্রতিনিয়তই আহত ও নিহত হচ্ছেন এইসব হতদরিদ্র দিনমজুর।
এই দিনমজুরেরা ক্রমাগত চরম অভাব অনটনে থাকতে থাকতে একসময় জীবনের মায়া না করেই গরু পারাপারে জড়িয়ে পড়েন। যেমন গত বুধবার গরু পারাপারের সময় সীমান্তে নিহত হন রৌমারী উপজেলার বারবান্দা গ্রামের মৃত মুন্না মিয়ার ছেলে নুর হোসেন। রাতে বাংলাদেশি কয়েকজনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সীমানা পিলার (এক হাজার ৬৬) এলাকা দিয়ে গরু আনতে যান তিনি। ।
এ সময় রৌমারী কালাইয়ের চরব্রিজের ওপর থেকে ঐ ব্যবসায়ীদের লক্ষ্য করে পাথর ছোড়ে ভারতের মাইনকারচর ক্যাম্পের টহলরত বিএসএফ সদস্যরা। এতে বাংলাদেশি এক গরু-আনা কামলা পাথরের আঘাতে আহত হয়ে পানিতেই মারা যান।
এছাড়া এক বছর আগে এই ব্রিজের নিচ দিয়ে গরু ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় একইভাবে পাথর ছুড়ে বিএসএফ হত্যা করেছিল আখিদুল নামের এক বাংলাদেশিকে। পরে তার তার লাশ কালাপানির বন্ধুরচরে নদীতে ভাসমান অবস্থায় উদ্ধার করেছিল পুলিশ।
রৌমারী কালাইয়ের চর ব্রিজের কাছে সীমান্তবর্তী চর ফুলবাড়িয়া, হিজলামারি,ফকিরপাড়া, নোটানপাড়ার দিনমজুরদের গরু পাচারের কাজে ব্যবহার করা হয়। স্বল্প সময়ে অধিক আয়ের লোভে সহজেই এসব দিনমজুর বলির পাঁঠা হয়। যেমন, ছয় মাস আগে গরু নিয়ে আনতে গিয়ে রৌমারী কালাইয়ের চর ব্রিজের কাছে নিহত হন লাল মিয়া। স্থানীয়ভাবে সবাই তাকে ‘দুখু মিয়া’ নামেই চিনতো।
দুখু মিয়া নামের সঙ্গে মিলে গেছে স্ত্রী আখতারা খাতুন (২১) ও সন্তান আরাফাত ইসলাম আলিফের (৩) অসহায়, বিপন্ন আর দু:খী জীবনের। বেহুলার চর সীমান্তে স্বামীকে হারিয়ে সন্তান নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন আখতারা।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, সীমান্তে বিএসএফ-এর গুলিতে স্বামী হারিয়ে চরম দুর্দশায় জীবন কাটছে তার। বর্তমানে শৈলমারি ইউনিয়নের ফকিরপাড়ায় বাবা জহুরুল ইসলামের বাড়িতে থাকেন তিনি।
সীমান্তে স্বামীর মারা যাওয়া প্রসঙ্গে আখতারা বলেন, রাতে খাওয়া দাওয়ার পরে বাইরে গেল। পরে শুনলাম বর্ডারে গুলি খাইচে। আমি এখন অসহায়। কিছুই করি না। বাবা আমাকে নিয়ে আসছে বাবার বাড়িতে থাকি খাই পরি। ’
‘স্বামী কিভাবে মারা গেছেন জানলেন কী করে?’ --এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনেক পরে শুনলাম বিএসএফ গুলি করেছে। আগে কিছুই জানতাম না। রাতে খাওয়া-দাওয়ার পরে বলে তুমি খিল (ঘরের খিড়কি) দাও। আমি আসছি। একটু পরেই গুলি খাইচে। শুধু দুখু মিয়ার সন্তানই যে বাবাহারা হয়েছে, এমন নয়। এমন হৃদয়বিদারক ঘটনা এই এলাকায় অহরহই ঘটে চলছে।
আরও পড়ুন:
গরু আসে বিশ্বাসে, টাকা পাচার হুন্ডিতে
বাংলাদেশ সময়: ০৫২০ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০১৭
এমআইএস/জেএম