ঢাকা, শুক্রবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

কাঁটাতার ডিঙিয়ে বাছুর, বড় গরু সাঁতরে পারাপার

মফিজুল সাদিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৪৬ ঘণ্টা, জুন ১৭, ২০১৭
কাঁটাতার ডিঙিয়ে বাছুর, বড় গরু সাঁতরে পারাপার কাঁটাতার ডিঙিয়ে বাছুর, বড় গরু সাঁতরে পারাপার

রৌমারী গরুর হাট (কুড়িগ্রাম) থেকে: রৌমারীর সীমান্তবর্তী দৈ খাওয়ার চর। সীমান্ত পেরিয়ে এসেছে লাল-সাদা-ধূসর বর্ণের একটি বাছুর। বয়স এক কি দেড় বছর। বাছুরটির পিঠের পিছনের দিকটা ক্ষত-বিক্ষত। ঘা শুকাতে হলুদ বেটে দেওয়া হয়েছে সেখানে। তারপরও জ্বলজ্বল করছে বাছুরটির গায়ের ক্ষত।

ভারতের রৌমারী সীমান্তজুড়ে কাঁটাতারের বেড়া। রৌমারীর বিভিন্ন চরে নদী সাঁতরিয়ে পারাপার করা হয় পাচারকৃত গরু।

কিন্তু নির্মমভাবে পার করানো হয় ছোট ছোট বাছুরগুলোকে। কাঁটাতারের বেড়ার মধ্য দিয়ে পার করতে গিয়ে এসব বাছুর ক্ষত-বিক্ষত হয়।  বাংলাদেশে ভারতের ছোট গরুর চাহিদা বেশি থাকায় এভাবেই প্রতিদিন পার হচ্ছে বাছুর। ২২ হাজার টাকায় কেনা এক একটি ছোট গরু গৃহস্থের গোয়ালে দেড়-দুই বছর পালার পর দাম বেড়ে দাঁড়াবে ৫৫ থেকে ৬০ হাজার টাকায়।

বাঁশের আড়ার সাহায্যে পার হওয়া এসব ছোট গরু খুলনা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, ফেনী, চট্টগ্রাম, ঢাকা, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহীসহ দেশের নানা স্থান থেকে পাইকারি ক্রেতারা ট্রাক ভর্তি করে নিয়ে যান।

চোরাই পথে গরু নিয়ে আসা বেপারীরা জানান, দু’দেশের বেপারীদের মধ্যে আগেই মোবাইলে কথোপকথন হয়। এরপরে সূর্য ডোবার আগে সীমান্তের নির্জন এলাকা দিয়ে গরু পাচারের জন্য আনা হয় কাঁটাতারের কাছে। বৃষ্টির দিনে ছোট গরু পারাপারে সুবিধা। কারণ, এ সময় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা ক্যাম্পে চলে যান। আর ঠিক তখনই শুরু হয় গরু পাচার। গরু পাচারে দু’দেশের সীমান্তে ঘোরাফেরা করে একাধিক চক্র।

তবে রৌমারীর খাঁটিয়ামারি, বেহুলার চর, চান্দার চরে বাঁশের আড়ার সাহায্যে নামানো গরুর খাজনা দেওয়া হয় না। ১৬ থেকে ২০ কিলোমিটার পথ মাড়িয়ে এসব বাছুর স্থানীয় কোনো হাটে তোলা হয় করিডর ছাড়াই।
কাঁটাতার ডিঙিয়ে বাছুর, বড় গরু সাঁতরে পারাপার
রৌমারী হাটে ভারতীয় গরু পাচারকারী এক বিক্রেতা বলেন, কাঁটাতারের বেড়ার ভারতীয় পাশে বড় বড় আকারের কয়েকটি বাঁশ মাটি খুঁড়ে দাঁড় করানো হয়। অনেকটাই দেখতে রেল লাইনের রেল ক্রসিংয়ে ব্যবহার করা বড় লোহার দণ্ডের মতো। তবে এটা চারিদিকে ঘোরানোর ব্যবস্থা রয়েছে। প্রথমে নেট জালের মধ্যে ছোট বাছুরটিকে প্রবেশ করানো হয়। এরপরে দ্রুত সময়ের মধ্যে চারটি পা এক করে শক্ত রশি দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়। ছোট গরু পা বাঁধা অবস্থায় বাঁশের মাথায় বেঁধে কাঁটাতারের অপর পাশে বাংলাদেশ অংশে ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর ভারতীয় অংশ থেকে রশি ধীরে ধীরে ছেড়ে দেওয়া হয়। এভাবে বাংলাদেশে চলে আসে বাছুর।

তবে গরু পারাপারে অধিকাংশ সময় ভুলবশত রশি দ্রুত ছেড়ে দেওয়া হয়। ফলে অনেক বাছুর কাঁটাতারের সঙ্গে লেগে ক্ষত-বিক্ষত হয়।  রৌমারী সীমান্ত হাটে ভারতীয় বাছুর দেখলেই চেনা যাচ্ছে। বেশিরভাগ বাছুরের শরীরে কাঁটাতারের ক্ষতচিহ্ন। এভাবে স্বল্প দামে ভারতীয় বেপারীরা বাংলাদেশে ছোট গরু বা বাছুর পারাপার করেন।

রৌমারী উপজেলার নদীপাড়ের যাত্রাপুর, কর্ত্তিমারী, দাঁতভাঙা, রৌমারী, রাজীবপুরসহ অন্য হাটগুলোতে জমে ওঠে ছোট গরু আর বাছুরে জমজমাট বিকিকিনি। দেড় মণ মাংস পাওয়া যাবে এমন গরু ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকায় পাওয়া যায় ওইসব হাটে।  স্থানীয়রা এসব গরুকে ‘আড়কি গরু’ নামে ডাকেন। বাঁশের আড়ার সাহায্যে নামানো হয় বলেই এই নামকরণ। আর এসব বাছুর বেচাকেনা যারা করেন তাদের বলা হয় আড়কির গরু ব্যাবসায়ী।

রৌমারীর জাদুর চর এলাকার আড়কির বেপারী শফিকুল ইসলাম (৪৫) প্রায় ১০/১২ বছর ধরে বাঁশের আড়ার সাহায্যে নামানো ছোট গরুর ব্যবসা করছেন। তার কয়েকজন সঙ্গী ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ’র গুলিতে মারা গেছেন।

গত বুধবারই গরু পারাপারের সময় সীমান্তে নিহত হয়েছেন রৌমারী উপজেলার বারবান্দা গ্রামের মৃত মুন্নু মিয়ার ছেলে নুর হোসেন। রাতে বাংলাদেশি কয়েকজন গরু ব্যবসায়ী আন্তর্জাতিক সীমানা পিলার ১০৬৬ এলাকা দিয়ে গরু আনতে যান। এ সময় রৌমারী কালাইয়ের চর ব্রিজের ওপর থেকে ওই ব্যবসায়ীদের লক্ষ্য করে পাথর ছুড়ে মারেন ভারতের মাইনকারচর ক্যাম্পের টহলরত বিএসএফ সদস্যরা। এতে বাংলাদেশি গরু ব্যবসায়ী নুর হোসেন আঘাত পেয়ে পানিতে পড়ে মারা যান।

তারপরও থেমে নেই বাঁশের আড়ায় পাচার হওয়া গরুর ব্যবসা। রৌমারীর বিভিন্ন হাটে ওঠা গরুর ৭০ শতাংশই ছোট ছোট বাছুর। কারণ, কাঁটাতার টপকে বাছুর পারাপার তুলনামূলকভাবে সহজ। এসব বাছুরের ওজন ৪০/৪৫ কেজি। এছাড়া নদীর স্রোতে ছেড়ে দিলে বাছুর ভেসে যাওয়ার ভয়ে বাঁশ দিয়েই সীমান্ত পার করেন পাচারকারীরা।

রৌমারীর দাঁতভাঙার বেপারী জহিরুল ইসলমাও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাঁশ দিয়ে পার করা ছোট গরুর ব্যবসা করেন। কীভাবে গরু পার করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ছোট গরু আড়কি দিয়ে পার করা হয়। কায়দা করে বাঁশ দিয়ে এপারে পাঠায় ভারতের বেপারী। কাঁটাতারের ওপারে বাঁশ গেড়ে আড়কি সিস্টেম করা হয়। এরপর আড়কি টান দিলেই গরু বাংলাদেশে পার হইয়া চলে আসে। ছোট গরু পার করা সহজ। ”

তবে বড় গরু বাঁশ দিয়ে পার করানো সম্ভব হয় না। তাই রৌমারী নৌপথে সাহেবের আলগা সীমান্ত দিয়ে পার হয় বড় গরু। নদী অথবা বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী সেতুর নিচ দিয়ে বড় গরু ছেড়ে দেওয়া হয়। পরে বাংলাদেশে এসব গরু করিডোর হয় বলে জানান ওই গরু ব্যবসায়ী।

তিনি বলেন, ভারত থেকে পানিতে ভাসিয়ে আনা এসব গরু প্রতি রৌমারী খেয়ার চরে গরুর বিটে সরকারি নিয়মে করিডোরে ৫০০ টাকা, টোল প্রতি ২০০ টাকা। এছাড়াও হাট মালিকের ট্যাক্স গরু প্রতি ৩০০ টাকা, মাতব্বরি চার্জ ২০০ টাকা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নামে ৩০০ টাকা খরচ হয়।

ভারতীয় গরু নির্ভর এসব বিট ইজারা দেওয়া হয়। পানি পথেই বড় গরু দেশে আনা হয় বলে জানান রৌমারীর আলগা বিটের ইজারাদার শহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, “গরু প্রতি এখন করিডোর খরচ মাত্র ৫০০ টাকা। বড় গরু পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। অনেক গরু স্রোতে হারিয়েও যায়। তবে ছোট বাছুর পার হয় আড়কি দিয়ে। ”

দিনে কী পরিমাণ ভারতীয় গরু প্রবেশ করে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এটা বলা মুশকিল। গরু পারাপারের বিষয়টা বিএসএফ-এর ওপর নির্ভর করে। ”

বাংলাদেশ সময়: ০৬৪৩ ঘণ্টা, জুন ১৭, ২০১৭
এমআইএস/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।