পাবনা শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরের ঈশ্বরদী উপজেলায় আরও আছে ইপিজেড, রেল জংশন, পাবনা সুগার মিলসহ অনেক সরকারি-বেসরকারি মিল-কারখানা ও স্থাপনাও।
যে লিচুর জন্য জগৎজোড়া বিখ্যাত পাবনা, সে লিচুও যেন অনেকটাই ঈশ্বরদী কেন্দ্রিক।
দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে সড়কপথে লালন শাহ সেতু ও রেলপথে সংযোগ স্থাপন করেছে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ।
পাবনা শহর থেকে সিএনজি অটোরিকশায় করে ঈশ্বরদী যাওয়ার পথে চোখে পড়ে ছায়া ঘন সবুজে ঘেরা দু’পাশ। কিছুক্ষণ পর পরই আখ ক্ষেতের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দেওয়া আম-লিচুর বাগানও জুড়িয়ে দেয় দু’চোখ।
এখন মৌসুম আম-লিচুর। পথের দু’ধারের বাগানগুলোর এক একটি গাছ যেন নুয়ে পড়েছে থোকায় থোকায় ঝুলে থাকা আমের ভারে।
মৌসুম আরও আগেই শুরু হওয়ায় বেশিরভাগ গাছেরই লিচু পেড়ে ফেলা হলেও অনেক গাছেই সবুজ পাতার ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে ঝুলে থাকা লাল টকটকে লিচুও।
পাবনা শহর থেকে ঈশ্বরদীর দিকে কিছুদূর যেতেই পড়ে টেবুনিয়ার হাট। সেখানকার হাটে ওঠা লিচুর দরদামে ব্যস্ত ক্রেতা-বিক্রেতারা।
টেবুনিয়া থেকে কয়েক কিলোমিটার পরই দাশুরিয়া মোড়। উত্তরবঙ্গসহ দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ক্রসিং এই মোড়। চারটি মহাসড়কের সংযোগস্থল মোড়টি দিয়ে একটি মহাসড়ক চলে গেছে রাজশাহী, নাটোর, বগুড়া সিরাজগঞ্জসহ উত্তরাঞ্চলের দিকে। আর একটি মহাসড়ক পাবনা হয়ে নগরবাড়ি ঘাটের দিকে গেছে। ঈশ্বরদী ও বাঘার দিকেও চলে গেছে আর একটি মহাসড়ক। আর পশ্চিম দিকের মহাসড়কটি গেছে লালন সেতু হয়ে দক্ষিণাঞ্চলের দিকে। উত্তর থেকে দক্ষিণবঙ্গের দিকে যাওয়া প্রতিটি যানবাহনকেই তাই দাশুরিয়া মোড় হয়ে যেতে হয়।
দাশুরিয়া মোড় থেকে একটু এগোলেই শুরু ঈশ্বরদী পৌর এলাকা। বেশ বড় এলাকা নিয়ে গঠিত এই পৌরসভা। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, দোকান-পাট, বসত-বাড়ি এবং আবাসিক এলাকা- সব মিলিয়ে ঈশ্বরদী বেশ উন্নত শহর। তুলনা চলে দেশের যে কোনো জেলা শহরের সঙ্গেই।
শহরের মূল বাণিজ্যিক কেন্দ্র স্টেশন রোড। এ সড়কের দুই ধারেই ব্যাংক, বিমা, বিপণি বিতান ও বহুতল ভবন। সড়কের বাম পাশে বিখ্যাত ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশন। কয়েক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এ জংশনের প্লাটফর্ম রয়েছে বেশ কয়েকটি। উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের মধ্যে রেল যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দু এই জংশনটি থাকে সব সময়ই ব্যস্ত।
ঘণ্টায় ঘণ্টায় এ জংশন অতিক্রম করছে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন গন্তব্যগামী ট্রেন। সারাদেশ থেকে ট্রেনে করে আসা পণ্যও আনলোড হয় ঈশ্বরদীতে। পরে মালবাহী ওয়াগনে চলে যায় উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন গন্তব্যে।
কয়েক কিলোমিটার দূরেই পাকশী এলাকায় পদ্মা নদীতে অবস্থিত বিশ্বের অন্যতম প্রকৌশল বিষ্ময় হার্ডিঞ্জ ব্রিজ রেলসেতু।
ঈশ্বরদী শহরের রেলগেট এলাকায় বাস টার্মিনাল ও সিএনজি অটোরিকশার স্ট্যান্ড। এখান থেকে সিএনজি অটোরিকশায় করে ২০ মিনিটের পথ রূপপুর। ঈশ্বরদী থেকে রূপপুর যাওয়ার পথটির দু’ধারেও লিচু আর আমের বাগান। বাগানগুলোর সামনের রাস্তায় গাছ থেকে সদ্য পাড়া লিচু নিয়ে বসে আছেন অনেক বাগানি। পথচলতি মানুষেরা কম দামেই কিনতে পারছেন লাল লাল টাটকা এই লিচুগুলো।
লালন শাহ সেতু ও হার্ডিঞ্জ ব্রিজের মুখে নির্মিত হচ্ছে দেশের একমাত্র পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। পুরোদমে কাজ চলছে এর। মূলত রাশিয়ান প্রকৌশলী ও টেকনিশিয়ানরাই বাস্তবায়ন করছেন পুরো প্রকল্প।
রূপপুর মোড়ের বাসস্ট্যান্ডও অনেক ব্যস্ত। কিছু্ক্ষণ পর পরই সেখানে এসে থামছে উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গগামী দূরপাল্লার যাত্রাবাহী কোস্টারগুলো। মানুষের ভিড়ে বেশ জমজমাট এ স্থানেও পসরা সাজিয়ে বসেছেন লিচু বিক্রেতারা। বাস থেকে নেমে অনেকেই কিনছেন লাল লাল সদ্য গাছ থেকে পেড়ে আনা লিচুগুলো।
রূপপুর বাসস্ট্যান্ড পার হলেই শুরু লালন শাহ সেতুতে ওঠার ঢাল। পাশেই ব্রিটিশ আমলে ইস্পাতে নির্মিত লাল রংয়ের হার্ডিঞ্জ রেলসেতু। দু’টি সেতু যেন হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে পদ্মার বুকে। সেতুর নিচে পদ্মার বুকে এখন সাদা বালুর চর। এই জুন মাসেও পানিতে ভরেনি পদ্মার বুক। সবই ফারাক্কার প্রভাব! সেতু সংলগ্ন নদীর দুই তীরেই নদীর বুক খুঁড়ে বালু তুলে নিচ্ছেন বালু ব্যবসায়ীরা। বালুমহাল ঘিরে ট্রাক, ট্রাক্টর ও নদীতে বাল্কহেডের ভিড়।
রূপপুর থেকে এক কিলোমিটার দূরের বাঘইল এলাকায় দেশের তৃতীয় বৃহত্তম রফতানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল ঈশ্বরদী ইপিজেড। ইপিজেড ও রূপপুরকে ঘিরে রীতিমতো শহুরে পরিবেশ এখানে। বাড়ি-ঘরগুলোতে আধুনিকতার ছাপ। বাঘইলে ইপিজেডের মূল গেটকে ঘিরে তৈরি হয়েছে ছোট-খাটো বাজারও। গ্রামের মধ্যে দিয়ে যাওয়া পিচঢালা পাকা সড়কের দু’পাশেও মাঝে মাঝেই দোতলা-তিনতলা বাড়ি।
ইফতারের সময় রশীদ স্টোর সংলগ্ন চায়ের দোকানে গিয়ে জানা গেছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও ইপিজেড ঘিরে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে এ এলাকার। জমির দামও বেড়েছে অনেক বেশি। ইপিজেডে কাজ করেন হাজার হাজার শ্রমিক-কর্মচারী ও কর্মকর্তা। তাদের অনেকেই ভাড়া থাকেন বাঘইল ও এর আশপাশের এলাকায়।
বাঘইলে ইপিজেডের গেট থেকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় সুন্দর মসৃণ পিচঢালা পথে ঈশ্বরদী শহরের দিকে যাওয়ার সময় পদ্মা নদীর দিক থেকে আসা সুন্দর ঠাণ্ডা বাতাস গা জুড়িয়ে দেয়।
সব মিলিয়ে পাবনা থেকে ঈশ্বরদী- সমৃদ্ধ একটি জনপদের ছবিই ধরা পড়েছে চোখে। যোগাযোগ ব্যবস্থা, কৃষিভিত্তিক শিল্প কারখানা, ইপিজেড এবং সর্বোপরি আম-লিচু আখের মতো অর্থকরী ফসলের কারণে ঈশ্বরদী যে দেশের অন্যতম সমৃদ্ধ জনপদ- একথা বলা যায় নিঃসন্দেহেই।
বাংলাদেশ সময়: ২০৩০ ঘণ্টা, জুন ০৫, ২০১৭
আরআই/এএসআর