প্রায় ৪৬১ বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যকে ধরতে প্রত্যেক বছরের এদিনে শুরু হয় ‘জামাইবরণ’ মেলা। শেরপুর উপজেলার অদূরে কেল্লাপোশী নামক স্থানে এ মেলায় আয়োজন করা হয়।
বাঙালির ঐতিহ্যবাহী এই মেলা। আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠার দিন। মেলা উপলক্ষে স্বজনদের নিমন্ত্রণ করা হয়। তালিকার প্রথমেই থাকেন নতুন-পুরনো জামাই-বউ। ভিন্ন আমেজে ভিন্ন পরিবেশে সবাই মিলেমিশে চলে বাড়ি বাড়ি উৎসব।
নিমন্ত্রণে আসা জামাইদের হাতে শ্বশুরালয়ের পক্ষ থেকে ধরিয়ে দেওয়া হয় মোটা অঙ্কের সেলামি। সঙ্গে থাকে নিজের গচ্ছিত টাকা। রীতিনীতি মানতে কিনতে হয় জ্যান্ত খাসি। বড় বড় জ্যান্ত মাছ আর হাঁড়িভর্তি মিষ্টান্ন। ছোট্ট শ্যালক-শ্যালিকাদের জন্য কিনতে হয় রকমারি খেলনা। এরপর ফিরতে হয় শ্বশুরালয়ে।
শনিবার (২৭ মে) দুপুরে তবিবুর রহমান, তাজেম উদ্দিন, আব্দুল হামিদ, আলতাফ হোসেনসহ একাধিক প্রবীণ ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে ইহিতাস-ঐতিহ্যসমৃদ্ধ কেল্লাপোশী মেলা সম্পর্কে এতথ্য জানা যায়।
মেলাটি ১৫৫৬খ্রিষ্টাব্দ থেকে হয়ে আসছে বলে কথিত আছে। কেল্লাপোশী মেলা সম্পর্কে জানা যায়, বৈরাগ নগরের বাদশা সেকেন্দারের একজন ঔরসজাত ও একজন দত্তক পুত্র ছিলেন। ঔরসজাত পুত্রের নাম ছিল গাজী মিয়া। কালু মিয়া ছিলেন দত্তক পুত্র। গাজী মিয়া দেখতে ছিলেন খুবই সুদর্শন। রাজ্যের মায়া ত্যাগ করে তারা ফকির সন্যাসীর বেশে ঘুরতে ঘুরতে ব্রাহ্মণ নগরে আসেন।
গাজীকে দেখে মুগ্ধ হন ব্রাহ্মণ রাজমুকুটের একমাত্র কন্যা চম্পা। একে অপরকে ভালবেসে ফেলেন তারা। পালিত ভাই কালু মিয়া বিষয়টি জানতে পারেন। পরে মুকুট রাজার কাছে ভাইয়ের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যান।
মুকুট রাজা ফকির বেশী যুবকের স্পর্ধা দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে বন্দি করেন। এতে গাজী মিয়া ভীষণ আঘাত পান। ভাইকে উদ্ধারের জন্য কেল্লাপোশী এলাকায় দূর্গ নির্মাণ করেন। পরে মুকট রাজার সঙ্গে যুদ্ধ করে তাকে পরাস্ত করেন। সঙ্গে ভাইকে উদ্ধার করে চম্পাকে বিয়ে করেন।
দিনটি ছিলো জ্যৈষ্ঠের দ্বিতীয় রোববার। সে সময় গাজীর বিয়ে উপলক্ষে কেল্লাপোশী দূর্গে নিশান উড়িয়ে তিন দিনব্যাপী আনন্দ উৎসব করা হয়। পাশাপাশি সেখানে মাজার গড়ে তোলা হয়। মেলা চলাকালে সেখানে ভক্তরা আসর বসান।
প্রতিবছর জ্যৈষ্ঠের দ্বিতীয় রোববার থেকে তিন দিনব্যাপী মেলা বসে। মেলা উপলক্ষে গ্রামের লোকজন নতুন জামাইকে ঘরে এনে আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠেন। আর স্বজনের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে মেলাপ্রাঙ্গণ।
মেলা শুরুর সপ্তাহখানেক আগ থেকে গ্রামে গ্রামে চলে মাদার খেলা। মেলা শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত চলে এই মাদার খেলা। জ্যৈষ্ঠের দ্বিতীয় রোববার মেলা এলাকায় অবস্থিত মাজার প্রাঙ্গণে গিয়ে তা শেষ হয়। ঐতিহ্যবাহী এ মেলাকে সামনে রেখে এলাকায় সাজ সাজ রব পড়ে গেছে।
মেলায় নাগোরদোলা, পুতুল নাচ, মোটর সাইকেল খেলা, কারখেলাসহ নানা অনুষ্ঠান চলে। মেলায় সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে কেনাকাটার ধুম। দূর-দূরান্ত থেকে আগত বিক্রেতারা এখানে দোকান সাজিয়ে জাঁকিয়ে বসেন।
মেলার প্রধান আকর্ষণ বিভিন্ন ধরনের কাঠের আসবাবপত্র, মিষ্টি-ফলমূল, নানা জাতের বড় বড় মাছ, কুঠির শিল্পের হরেক সামগ্রী, মহিষ ও খাসির মাংস এবং রকমারি মসলা। এ মেলায় কোটি টাকার দ্রব্যাদি কেনাবেচা হয়।
শেরপুর থানার পুলিশ পরিদর্শক (ওসি-তদন্ত) বুলবুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, মেলা করতে কমিটির পক্ষ থেকে ৩দিনের অনুমতি চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। মেলায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। মেলায় কোনো প্রকার অশ্লীল নাচগান ও জুয়া খেলতে দেওয়া হবে না।
বাংলাদেশ সময়: ১৮১৪ ঘণ্টা, মে ২৭, ২০১৭
এমবিএইচ/জেএম