ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

একজন তবিবুর ও লাউয়াছড়া

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৩৪ ঘণ্টা, মে ২৭, ২০১৭
একজন তবিবুর ও লাউয়াছড়া সহকারী বন সংরক্ষক (ওয়াইল্ড লাইফ, মৌলভীবাজার) তবিবুর রহমান

মৌলভীবাজার থেকে: অনেকে রয়েছেন, যারা নিরবে-নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছেন। এখনো মোহ যাদের স্পর্শ করতে পারেনি, না পেরেছে ভয়ভীতি টলাতে।

তেমনি একজন ব্যক্তিত্ব সহকারী বন সংরক্ষক (ওয়াইল্ড লাইফ, মৌলভীবাজার) তবিবুর রহমান। ১৭ বছরের চাকরি জীবনে বনবিভাগে সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক হয়ে উঠেছেন।

মৃদুভাষি এই লোকটি যে কতোটা দৃঢ়চেতা তা আন্দাজ করা কঠিন। হেসে হেসে অনেক শক্ত সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিতে পারেন অনায়াসে।

সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে অবিচল। সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আবার চাপের কাছে পরিবর্তন করেছেন। এমন নজির নেই তার ডিকশনারি। এমনকি কোনো বসও তাকে সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারেনি এক চুলও।
সহকারী বন সংরক্ষক (ওয়াইল্ড লাইফ, মৌলভীবাজার) তবিবুর রহমান

চাকরি জীবনের শুরুতে প্রথম পোস্টিং হয় রংপুর বন বিভাগে। তিনি ঘুরে দেখলেন, বনের শত শত বিঘা জমি বেদখল হয়ে গেছে। উজাড় করা হচ্ছে বন। তৎপর হলেন জবরদখল হওয়া জমি উদ্ধারে। কিন্তু তৎকালীন বিএনপি সরকারের প্রভাবশালী অনেক নেতাই বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাকে নিবৃত করার জন্য প্রকাশ্য হুমকিও দেন।

কিন্তু দৃঢ়চেতা তবিবুর রহমান ছিলেন অনঢ়। শেষ পর্যন্ত তারই জয় হয়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে সঙ্গে নিয়ে একে একে গুঁড়িয়ে দেন সব অবৈধ স্থাপনা। রংপুরের মিঠাপুকুর, বদরগঞ্জ ও পীরগঞ্জে বন বিভাগের সাড়ে তিনশ’ একর জমি অবৈধ দখল থেকে উদ্ধার করে বনায়ন করেন।

এমনকি বিএনপি নেতার পাকাবাড়িও বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেন। আর তখন তাকে প্রকাশ্যেই হুমকি হজম করতে হয়। তারেক জিয়ার কাছের লোক বলে পরিচিত এক বিএনপি নেতা, প্রকাশ্যে তাকে বান্দরবানে বদলির হুমকি দিয়েছিলেন। জবাবে তবিবুর রহমান হেসে বলেছিলেন, সেখানে আমি এই পদেই থাকবো, পারলে তাড়াতাড়ি বদলির ব্যবস্থা করেন। প্রয়োজনে আমি কিছু খরচও দিতে রাজি আছি।
সহকারী বন সংরক্ষক (ওয়াইল্ড লাইফ, মৌলভীবাজার) তবিবুর রহমান

একবার তো কাদিরাবাদ বন বিটের জায়গা দখল করে জিয়াউর রহমানের নামে স্টেডিয়াম করার উদ্যোগ নেন বিএনপির এক নেতা। বন বিভাগের লোকজন চারা রোপণ করতে গেলে তাদের মারধর করে ফিরিয়ে দেয়া হয়। সেখানেও ঘুরে দাঁড়ান তবিবুর রহমান। ওই সময় একটি রহস্যজনক মার্ডারও হয় ওই এলাকায়। তারপরও জমি উদ্ধার করে তবেই ক্ষান্ত দেন।

একদিকে, যখন বিএনপি নেতার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছিলেন। অন্যদিকে তখন তৎকালীন স্থানীয় সংসদ সদস্যদের সঙ্গে লড়তে হয় তাকে। স্থানীয় এক সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের করেন তিনি। শেষ পর্যন্ত সংসদ সদস্য অবৈধ দখলি জমি ছাড়তে বাধ্য হন।

রংপুর থেকে বদলি করা হয় ফরিদপুর বন বিভাগে। সেখানেও রাস্তার গাছ রোপন এবং রক্ষায় কঠিন ভূমিকা পালন করেন। সংঘবদ্ধ গাছচোরদের কাছে মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হন তিনি। তার সাহসী পদক্ষেপের কারণে বন্ধ হয়ে যায় মহাসড়কের গাছ চুরি।
সহকারী বন সংরক্ষক (ওয়াইল্ড লাইফ, মৌলভীবাজার) তবিবুর রহমান

এরপর চলে যান ওয়াইল্ড লাইফ প্রটেকশনের ওপর উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য। দেশে ফেরার পর ২০১৫ সালের নভেম্বরে পোস্টিং দেয়া হয়েছে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে। এখানে এসেও তার স্বভাবজাত কার্যক্রম করে আসছেন।

ক্ষয়িষ্ণু লাউয়াছড়াকে রক্ষার পাশাপাশি বন বিভাগের হাতছাড়া হওয়া জমি উদ্ধারেও তৎপর তিনি। এরই মধ্যে প্রভাবশালীদের দখলে থাকা সাড়ে ৩২ একর জমি উদ্ধার করেছেন। যা এতোদিন কেউ কল্পনাও করতে পারেনি।

গাছ চুরির হিড়িক ছিল এখানেও। মামলা হলেও তদবিরের কারণে আসামিরা প্রকাশ্যে ঘোরা ফেরা করতো। যে কারণে দ্বিগুণ উৎসাহে গাছ কেটে বন উজাড় করতো। তবিবুর রহমান আসার পর থেকে আসামিদের গ্রেফতার এবং কোর্টে হাজিরা দিতে গেলে জামিন না দেয়ার চেষ্টা করেন। এতে সফলতা মিলেছে হাতে হাতে। এখন হাজিরা দিতে গেলেই আটকে যাচ্ছে গাছচোররা। যে কারণে উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে গাছ চুরি।

জীবনে অনেক হুমকির মুখে পড়েছেন। শাসকদলের নেতাদের রোষাণলেও পড়েছেন। কিন্তু এসব কিছুই সিদ্ধান্ত থেকে তাকে টলাতে পারেনি এক চুলও। এ কারণে বদলিসহ নানা রকম হুমকি হজম করতে হয়েছে তাকে। আবার কখনও কখনও স্বার্থে ব্যাঘাত ঘটায় অনেকের বিরাগভাজন হতে হয়েছে। কিন্তু আদর্শচ্যুত হননি কখনও।  
সহকারী বন সংরক্ষক (ওয়াইল্ড লাইফ, মৌলভীবাজার) তবিবুর রহমান

যেখানেই যোগ দিয়েছেন, সেখানেই নানান প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তাকে সরিয়ে দেয়ার জন্য এক শ্রেণির লোক সব সময়েই ছিলেন তৎপর। কখনও কখনও তার বিরুদ্ধে নামে-বেনামে দরখাস্তও হয়েছে বিস্তর। এখনও থেমে নেই।

কিন্তু এগুলোকে কখনও তিনি পরোয়া করেননি। এখনও করেন না। তার সাফ কথা, বদলি করার হুমকি দেয়া হয়। বদলি হলে কি হবে। পুরো দেশটাই আমার কাছে আপন। যেখানে যেতে হয় যাবো। কিন্তু কারো সঙ্গে আপোষ করে কোথাও একদিনও থাকতে চাই না।

মৌলভীবাজারেও তার চলার পথ মসৃণ হয়নি। নানা রকম হুমকি ধামকির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। তাকে হয়রানি করার জন্য নামে বেনামে করা হচ্ছে অভিযোগ। বিভাগীয় বন কর্মকর্তা স্বীকার করলেনও সে কথা। অনেক অভিযোগ করা হয়, আমার কাছে এলে ফেলে রাখি। কারণ আমি জানি, তিনি কতোটা দৃঢ়চেতা এবং সৎ অফিসার। তার অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে সম্ভব হয়েছে লাউয়াছড়াকে রক্ষা করা। এক শ্রেণির অসাধু লোকের সমস্যা হচ্ছে। যে কারণে তারা এসব মিথ্যা অভিযোগ করছে। চলবে…

বাংলাদেশ সময়: ১৯৩০ ঘণ্টা, মে ২৭, ২০১৭
এসআই/
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।