ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

বারো তীর্থের দীঘিজলে পূণ্যস্নান ও বউমেলায় মানুষের ঢল

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৮, ২০১৭
বারো তীর্থের দীঘিজলে পূণ্যস্নান ও বউমেলায় মানুষের ঢল বারো তীর্থের দীঘিজলে পূণ্যস্নান ও বউমেলায় মানুষের ঢল

মধুপুর(টাঙ্গাইল): টাংগাইলের মধুপুর গড়াঞ্চলের শোলাকুড়িতে বারো তীর্থের দীঘির চারপাশ প্রদক্ষিণ, কীর্তন ও পূজা শেষে দীঘির জলে দিনব্যাপী পূণ্যস্নান ও পরের দিন শোলাকুড়ি বাজারস্থ মাঠে সকাল থেকে রাত অবধি বৈশাখী ও বউ মেলা এ জনপদের কয়েক শতকের ঐতিহ্যের  ধারাবাহিকতা। 

চান্দ্র মাসের নির্ধারিত ক্ষণগণনায় এবারও  বুধবার(২৬ এপ্রিল) ও বৃহস্পতিবার(২৭ এপ্রিল)  নানা কর্মসূচিতে ঐতিহ্যবাহী এ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হচ্ছে।  
টাংগাইল, ময়মনসিংহ ও জামালপুর জেলার সীমান্তবর্তী এই স্থানে গত কয়েশ বছর ধরে চলে আসা এই আয়োজনে আশপাশের ও দূরদূরান্তের অসংখ্য পুণ্যার্থী অংশ নিয়েছেন।

কমতি নেই দর্শক সংখ্যায়ও। অর্থাৎ এক কথায় ঐতিহ্যের এ অনুষ্ঠানে অসংখ্য জনসমাগম। যাকে বলে পূণ্যার্থী  মানুষের ঢল।  

বুধবার(২৬ এপ্রিল) প্রথমদিন সকাল থেকে দিনব্যাপী চলেছে পূণ্যস্নান আর বৃহস্পতিবার (২৭ এপ্রিল) অনুষ্ঠিত হয়েছে বউমেলা।

দশ বছর বয়স থেকে ওই দীঘির জলে স্নান ও পূজা করে আসছেন মধুপুর পৌর শহরের বাসিন্দা শচীন্দ্র চন্দ্র বর্মন (৯২)। তার কাছে জানা গেল পূণ্যস্নান, কীর্তন,পূজা ও বউমেলার পেছনের কাহিনী।  
তিনি জানান, এ অঞ্চলের গহীণ অরণ্যে বাস করতেন রাজা ভগদত্ত। মাতৃভক্ত এই রাজার মা একবার ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। কথিত আছে, কোনো চিকিৎসায় তিনি সুস্থ না হওয়ায় স্বপ্নে দেখেন বারো তীর্থের জল দিয়ে স্নান করলে তিনি আরোগ্য লাভ করবেন। মায়ের আদেশে আদিষ্ট হয়ে রাজা ভগদত্ত ১২ ঘোড়ায় ১২ রাজকর্মচারিকে পাঠিয়ে দেন বারো তীর্থের জল আনতে। ঘোড়ার সোয়ারী ওই ১২ জন ভারতের বৃন্দাবন, মথুরা, প্রয়াগ, গয়া, কাশি এরূপ বারো তীর্থ থেকে জল এনে বর্তমানে শোলাকুড়ি যে স্থানে দীঘি সেই স্থানের মাঝখানে বসিয়ে বৈশাখের অমাবস্যার রাতে রাজার মাকে স্নান করালে তিনি আরোগ্য লাভ করেন। একথা পরে লোকমুখে রাষ্ট্র হয়ে যায়। পরে রাজা বারো তীর্থের পবিত্র জল সংরক্ষণের লক্ষে সেখানেই দীঘি খননের ব্যবস্থা করেন। সেই দীঘিই এখন শোলাকুড়ির বারো তীর্থের জলের দীঘি।

এই কাহিনীকে ঘিরে তখন থেকেই এ দীঘির জলে পূণ্যস্নান,পূজার্চ্চনাসহ নানা আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে।
বারো তীর্থের জলে পূণ্য স্নান ও আরোগ্য লাভের আশায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অসংখ্য হিন্দু নারী-পুরুষ এই দিনে এখানকার নানা আয়োজনে অংশ নিলে জনাসমাগমের সৃষ্টি হয়। তা রূপ নেয় মেলায়। এই মেলা এখন ঐতিহ্যে অংশ।

এ উপলক্ষে ওখানে গ্রামীণ জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির পরিচয়বাহী হরেক রকম বাহারী পণ্যের জমজমাট কেনাবেচা চলে। হাজার হাজার মানুষ এই মেলায় সংসারের সাংবাৎসরিক কেনাকাটা করেন। বাদ যান না গৃহবধূরাও। মেলার ২য় দিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত শুধু মহিলারা কেনাকাটা করেন। মেলায় কোনো পুরুষের প্রবেশাধিকার ওই সময়ে নেই।

সারা এলাকায় পুলিশি নিরাপত্তার পাশাপাশি গেটে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকরা পাহারা দিয়ে এই ব্যবস্থা বহাল রাখেন। ওই সময়টায় গ্রাম্য গৃহবধূরা নির্বিঘ্নে প্রয়োজনীয় কেনাকাটা সারেন। বাইরে অনেক কৌতূহলী মানুষ দর্শক হয়ে এই ব্যতিক্রমী দৃশ্য অবলোকন করেন। প্রতিবারের মতো  বৃহস্পতিবার(২৭ এপ্রিল) শোলাকুড়িতে অনুষ্ঠিত হয়েছে ঐতিহ্যের এই বউমেলা।
বউ মেলায় অংশ নিতে আসা সন্ধ্যা রাণী জানান, ছোট বেলায় মায়ের সাথে এই মেলায় আসতাম। প্রতিবারই আসি। এবারও এসেছি আনন্দ উপভোগের সাথে সন্তানের জন্যে খেলনা, নিজের,মায়ের ও বাড়ির জন্যে কিছু কিনবো বলে।  

একই মন্তব্য বাপের বাড়িতে নাইওর আসা মাহমুদা নামের জনৈক গৃহবধূরও।
স্থানীয় তরুণ আল আমিন হোসেন, দোখলার রফিকুল ইসলাম মনে করেন, বাঙালি সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে এলাকার এ ঐতিহ্যের প্রতি সংশ্লিষ্টদের নজর দেয়া দরকার।
 
শোলাকুড়ী ইউপি চেয়ারম্যান, উপজেলা  আ’লীগের সহ-সভাপতি ইয়াকুব আলী বলেন, বাপদাদারা দেখেছেন, আমরাও দেখছি। মোগল আমল থেকে চলে আসছে। শুনেছি-বারো তীর্থের এই অনুষ্ঠানে দেশের নানা জায়গা থেকে অসংখ্য নারীপুরুষ, সাধু-সন্ন্যাসী শোলাকুড়ির এই স্থানে এসে জমাযেত হতেন এবং কীর্তন-পূজায় অংশ নিতেন। কীর্তন করে শেষরাতে দীঘির পাড়ে গিয়ে ধর্মীয় আচার শেষে আবার এই জায়গাতে ফিরে আসতেন। ফলে গত কয়েকশ বছর ধরে ধারাবহিকভাবে চলে আসা এই আচারের জমায়েতটা সর্বজনীন মেলায় রূপ নিয়েছে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা তাহমিনা মল্লিক জানালেন, এই অঞ্চলের মানুষদের কাছে ঈদের চেয়ে বেশী উপভোগ্য এই দিনটি। ছোটদের সালামি, বাড়িতে মিষ্টি, নাইওর আনা সব কিছুই হয়।
বাংলাদেশ সময়: ০৬৫৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৮, ২০১৭
জেএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।