ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

ফসল হারানোর ধাক্কা হাওরের ব্যবসায়ও

এম আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪২৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৫, ২০১৭
ফসল হারানোর ধাক্কা হাওরের ব্যবসায়ও ব্যবসার মন্দাভাবে হতাশ হোটেল মালিকরা। ছবি: অনিক খান

কিশোরগঞ্জের হাওর ঘুরে এসে: বিসমিল্লাহ হোটেলে ভিড় নেই। ক্যাশ বাক্স আগলে বসা মালিক রিপন দাসের মুখ ভার। ক্রেতার অভাবে কমিয়ে দিয়েছেন খাবারের পদ, বিক্রি নেই সেগুলোরও।

হাওরের দুর্যোগে বড় ধাক্কা খেয়েছে খাবারের ব্যবসা। লোকসান জেনেও দু’মুঠো খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে ধরে রেখেছেন ব্যবসা।

নদীর কুলঘেঁষা হোটেলের পেছনের দিকটায় সাঁই সাঁই শব্দে হানা দিচ্ছে দমকা বাতাস। জানালা দিয়ে ভেতরে আসা ঠাণ্ডা হাওয়া কাঁপন ধরাচ্ছে রিপনের বুকেও।

টালমাটাল ঘোড়া উতরার দিকে উদাস তাকিয়ে আক্ষেপ করে বলেন, ‘কৃষিজীবীদের ওপর নির্ভর করেই চলে এখানকার হোটেল ব্যবসা। ঢলের পানিতে জমির ফসল তলিয়ে যাওয়ায় কৃষকের হাতে টাকা নেই। অভাব জেঁকে বসা হাওরের হোটেলগুলোতেও তাই অর্ধেকে নেমে এসেছে বিক্রি-বাট্টা’।

গম গম করা হোটেল এখন প্রায় ক্রেতাশূন্য।  ছবি: অনিক খানতার মতোই মিঠামইন উপজেলা সদরের বাজারের সব খাবারের হোটেলের ব্যবসায় ধস নেমেছে।

চৈত্রের মধ্যভাগে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ফসল হারিয়েছেন হাওরের কৃষকেরা। পানিতে তলিয়ে যাওয়া ধানে পচন ধরেছে। অনেক কৃষক বুক সমান পানিতে ঝুঁকি নিয়ে ফসল কেটে আনার বৃথা চেষ্টা করছেন। শীতের সঙ্গে টিকতে না পেরে শূন্য হাতে ফিরেও আসছেন।

ভরদুপুরে বা সন্ধ্যায় চায়ের দোকানে সেই জমানো আড্ডাটা আর নেই হাওরের বাজারগুলোতে। হাঁটা পথের ইটনা উপজেলা সদরের চায়ের দোকানগুলোতেও মিলছে না ক্রেতা।

ইটনা উপজেলা সদর বাজারের চা দোকানি জামাল মিয়া (৩৮) এবার ছাড়তে চাচ্ছেন এ ব্যবসা। পাশের চারটি দোকানের বন্ধ ঝাঁপ দেখিয়ে জানালেন, বেচা-বিক্রি নেই। জমি-জমা তলিয়ে যাওয়ায় দোকানে ক্রেতা আসছেন না।

চা দোকানি রেজাউলও বোরোর আবাদ করেছিলেন। থই থই জলরাশিতে সব হারানোর প্রতিচ্ছবি তার চেহারায়। এ দোকানির ভাষায়- ‘এক ফসলি জমির ধানেই চলতো সারা বছরের সংসার’।

কিন্তু নদীর বাড়ন্ত পানিতে ফসলের সঙ্গে হাওরপাড়ের বাসিন্দাদের স্বপ্নও তলিয়েছে। গৃহস্থের মনে সারা বছরের অন্ন জুগানো একমাত্র ফসল হারানোর হতাশা। চোখের সামনেই রাতারাতি তলিয়ে যাওয়া ধানক্ষেতের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের কান্না যেন থামছেই না।  

কঠোর পরিশ্রমে বোনা ফসল বানের পানিতে ভেসে যাওয়ায় ধান শুকাতে বা গোলা তৈরি করতে চাঁটাইয়েরও প্রয়োজন পড়ছে না। ফলে বিক্রি না হওয়া চাঁটাই পোকার খপ্পড়ে নষ্ট হচ্ছে।

দোকানে হাজার কয়েক অবিক্রিত চাঁটাইয়ের মজুদ দেখিয়ে লোকসানের কথা জানালেন ইটনার পুরাতন বাজারের ব্যবসায়ী আলী রহমান।

হাওরের কৃষকের স্বপ্নের সমাধির পর মড়ক লেগে মরতে শুরু করেছে হাঁসের পালও। ক্ষেত পচা ধান, আগাছা আর দূষিত পানি হাঁসের খামারিদের ক্ষতি বাড়িয়েছে।

কৃষকের ঘরে খাবার না থাকায় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহের পথটিও বন্ধ হতে বসেছে।

কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকাগুলোতে মাছের মড়ক না থাকলেও সুনামগঞ্জে টনকে টন মাছ মরে ভেসে ওঠার খবরে কেউ আর মাছ খাওয়ার সাহস করছেন না। এর প্রভাব পড়েছে এখানকার হোটেল ব্যবসায়ও। ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল অনিশ্চিত উদ্বেগের দিকেই ঠেলে দিয়েছে এ ব্যবসায়ীদেরও।  

খাবারের পদ কমিয়েও লোকসান বাড়ছেই।  ছবি: অনিক খানএমন সঙ্কটের সময়েও নদী থেকেই টাটকা বোয়াল, আইড় আর পাবদা মাছ কিনে রান্না করেন অষ্টগ্রাম বড় বাজারের হোটেল ব্যবসায়ী মিনহাজ উদ্দিন (৪০)। পাশের নোয়াহাটি গ্রামে তার বাড়ি।

তিনি বলেন, ‘সুনামগঞ্জের মাছ মরার আতঙ্কে এখানকার হোটেলে কাস্টমার নেই। কৃষকের মতো ব্যবসায়ীরাও থুম (ঝিম) মাইরা আছে’।

**পচা ধানেই হাঁসের মরণ!
** হাওরে দুর্যোগে নেই পাউবো-এলজিইডি!
** ‘হাওর ভাত দেয় না, গৃহস্থরেই মারে’
** কলাগাছের ভেলাই যেন হাওরে ‘সোনার তরী’!
** হাওর বধূদের মুখেও আঁধার!
** হাওরে কৃষকদের দুর্দিনে মাথায় হাত চাটাই ব্যবসায়ীদের
** চোখ-নদীর জল একাকার হাওরের জলে!
** হাওরে বিদ্যুৎ যায় না, আসে!
** শুন্য হাতে ফিরছেন ‘জিরাতিরা’

বাংলাদেশ সময়: ১০৩০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৫, ২০১৭
এমএএএম/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।