ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

মালিকের লস নাই পত্তনি নিঃস্ব

জাকারিয়া মন্ডল, সিনিয়র আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৩৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০১৭
মালিকের লস নাই পত্তনি নিঃস্ব ডুবে যাওয়া জমি-ছবি: অনিক খান

অষ্টগ্রাম ( কিশোরগঞ্জ) থেকে: কলাপাড়ার আবু তাহের ২০ হাজার টাকা অগ্রিম দিয়ে ১ একর জমি পত্তনি নিয়েছিলেন বড় হাওরে। জাকির হোসেন ২ একর নিয়েছিলেন ৮ হাজার করে ১৬ হাজার টাকায়। ১০ হাজার করে ৪৫ হাজার টাকায় সাড়ে ৪ একর পেয়েছিলেন মোতালেব। একইভাবে তফিজ মিয়া ৭ একর, আর জিতু মিয়া ১২ একর জমি পত্তন নিয়েছিলেন মালিকের ট্যাঁকে অগ্রিম টাজা গুঁজে দিয়ে।

আবু তাহেরের ২০ হাজার অগ্রিম বিনিয়োগের সঙ্গে যোগ হয়েছে আরো ২০ হাজার মহাজনি ঋণ। মোতালেবেরও একর প্রতি চাষের খরচ আরো ২০ হাজার।

জাকির, তফিজ আর জিতুকেও একইভাবে মহাজনের দাদন নিয়ে ফসল বুনতে হয়েছে বড় হাওরের অষ্টগ্রাম প্রান্তে।  

কিন্তু তাদের জীবনের স্বপ্ন বুনে রাখা সোনালী ফলস সবই তলিয়ে গেছে আগাম ঢলে। ধান কাটতে গিয়ে ফিরে এসেছেন জাকির হোসেন। হাতে তার এক গোছা ধান। বারবার চোখের সামনে তুলে সেই গোছাটাই দেখছেন জাকির। পত্তন নেওয়া জমিতে মাথা তোলা পুষ্ট শীষে পুষে রাখা স্বপ্নটা যে ওই হাওরের জলে এভাবে হারিয়ে যাবে সেটা বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছে তার।  

ফসল কাটতে দিয়ে টইটুম্বুর পানির কাছে হার মেনে ফিরে এসেছেন আরেক পত্তনি চাষি আঙুর মিয়াও। হাওরের দিকে চেয়ে চেয়েই বললেন, জমি দেখতে পারি নাই ভয়ে। নদী সাগর হয়া গেছে। বিল হইছে মহাসাগর।
ডুবে যাওয়া জমির দিকে চোখ-ছবি: অনিক খান
জীবনের সব স্বপ্ন তারা ওই হাওরের জমিতে বুনলেও হা হুতাশ ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই আর। মাথার ওপরে কেবল চেপে বসেছে চড়া সুদে নেওয়া ঋণের বোঝাটা।

যারা নিজের জমি নিজেরা চাষ করেছেন তাদের কথা আলাদা। কিছু ক্ষুদ্র বা প্রান্তিক গৃহস্থও ফসল হারিয়েছেন অকাল ফলে। কিন্তু অগ্রিম নিয়ে পত্তন দেওয়া জমি মালিকের কোনো ক্ষতি হয়নি এবারের আগাম বন্যায়। তবে পত্তন নেওয়া কৃষকের নিস্তার নেই ফসল হারিয়েও।
একে তো খোরাকির চিন্তা, তারওপর ঋণশোধের দায়!

মোতালেবের ভাষায়, সমিতির লোনের কিস্তি টানতে হয় মাসে ২৫/৩০ হাজার করে। এক জায়গার লোন নিয়া আর এক জায়গটারটা শোধ করি। এবার তো আর কেউ লোনও দিবো না। কিস্তির টাকা দিতে না পারলে মান-সম্মানটাও চলে যাবে।  

গত ৭ দিন ধরে কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকা ইটনা, মিঠামইন আর অষ্টগামের বিভিন্ন গ্রাম, বিল ঘুরে দেখা গেছে, বিশাল হাওরের হাওরে এবার মূলত ক্ষতিগ্রস্ত পত্তনি চাষিরাই। একে তো তারা অগ্রিম টাকা দিয়ে জমি নিয়েছে মৌসুমের শুরতেই। তার সঙ্গে নিয়েছে দেড় গুণ সুদে ঋণ। ৬ মাস আগে ১ হাজার টাকা ঋণ নিলে এখন দেড় হাজার টাকা দেনা হয়েছে সবার।

বর্গা চাষি আর জিরাতিরা থাকলেও এই পত্তনি চাষির সংখ্যাই বেশী হাওরে।

নিজের চাষ করা ৫০ একর জমির ফসল বড় হাওরের পানিতে হারানো মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আহাদ মাস্টারের কথাতেও ওই পত্তনিদের জন্যই মায়া। ফসল হারানো কয়েকজন পত্তনি চাষিকে ডেকে নিয়ে বললেন, অনেক জমি মালিকই জমি পত্তন দিয়ে দেন। জমি মালিককে টাকাটা দিয়ে দিতে হয় আগেই। কিন্তু এই পত্তনিদের ভাগ্যে যোগ হয় ব্যাংকের লোন, মহাজনের ঋণ।   
হাওর পাড়ে আব্দুল আহাদ মাস্টারকে ঘিরে পত্তনি চাষিদের ভিড়।  ছবি: অনিক খান
রাঙালপাড়ার ব্যবসায়ী রাধাকৃষ্ণ সরকার বলেন, এবারের বন্যায় পত্তনী কৃষকরাই বেশী ক্ষতিগ্রস্ত। যাদের ২০/৩০ একর জমি আছে তারা নিজেরা চাষ করেন না। পত্তনি দিয়ে দেন। পত্তনের নিয়ম অনুসারে জমি মালিককে পুরো টাকাটা অগ্রিম দিয়েই জমি চাষ শুরু করতে পারে কৃষক। এবার ওরা নি:স্ব।
বাঙালপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এনামুল হক ভূঁইয়া বলেন, পত্তনিদের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার ব্যবস্থা নাই। জমি ধরে রেকর্ড হলে ক্ষতিপূরণ যাবে জমি মালিকের ঘরে। ক্ষতিগ্রস্ত পত্তনি চাষি ক্ষতিগ্রস্তই রয়ে যাবে।

বাঙালপাড়ায নাসিরনগর থেকে এসে অনেকে জমি জিরাতি আর পত্তনি করেছেন জানিয়ে এনামুল হক ভূঁইয়া বলেন, অন্য ইউনিয়নের হওয়ায় ওদের জন্য তো সরকারি সাহায্য দেওয়াও মুশকিল হয়ে পড়বে।   

আরও পড়ুন
** ঢলের ঘায়ে দাদনের ছিটা
** চোখ তবু হাওরের জলে
**ডুবে যাওয়া ফসলের দ্বীপগ্রাম
** তবু যদি কিছু মেলে
** গরু মরবে ঘাসে
** সামনে এবার মরার বছর
** মাছ নাই রে ভাই
** ধুঁকতে থাকা স্বপ্নও শেষ বৃষ্টিতে

** রোদের জন্য হাহাকার
** কামলা হয়ে হাওর ছাড়ছে গৃহস্থ

বাংলাদেশ সময়: ০৯২৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০১৭
জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad