ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

কামলা হয়ে হাওর ছাড়ছে গৃহস্থ

জাকারিয়া মন্ডল, সিনিয়র আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫২ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০১৭
কামলা হয়ে হাওর ছাড়ছে গৃহস্থ কামলা হয়ে হাওর ছাড়ছে গৃহস্থ- ছবি: অনিক খান

অষ্টগ্রাম (কিশোরগঞ্জ) থেকে: আমরার নিজের জমিন করি। এখন খাটুম কামলা। জীবনে বাহিরে গেছি না। এটুকু বলে উদাস চোখে বাড়বাড়ন্ত ঘোড়াউতরার দিকে তাকিয়ে থাকেন বরুণ শীল।

আকাশ গলে অঝোরে ঝরতে থাকা বৃষ্টি নাচছে টালমাটাল জলের বুকে। সেদিকে তাকিয়ে থেকেই ফের বলতে শুরু করেন, ১০ সের চাল আর ১০ সের আটা থুইয়া আইছি বাড়িত।

দিয়ে ৩ মেয়ে, ১ ছেলে আর বউ ক’দিন চলবো ওরাই জানে।

প্রতি মৌসুমের মতোই এবারো নিজের জমিতে ধান বুনেছিলেন প্রান্তিক গৃহস্থ বরুণ। কিন্তু অকাল বন্যায় তলিয়ে গেছে সব। তার মতোই সব জলে গেছে অল্প জমির মালিক বিলু দেবনাথ, রতন সরকার, গণেশ নাথ আর নরেণদের। ক্ষুদ্র গৃহস্থ ওরা। তবু সারা বছরের খোরাকির ধানটা নিজেরাই আবাদ করতেন মহাজনের ঋণে।

ফসল উঠলে খোরাকির ধানটা রেখে শোধ হতো দাদনের ঋণ। কখনোবা আসলের দেড় গুণ ফেরত দিতে গিয়ে টান পড়তো খোরাকিতেই। তবু এতো দিন এভাবেই চলছিলো সব। কিন্তু এবারের অকাল ঢলে ভেঙ্গে গেছে ওদের জীবন যুদ্ধের সব ব্যকরণ।

৯০ দিনে তোলা যায় বলে বিরি ২৮ জাতের ধানটাই এবাবো বুনেছিলে ওরা। কিন্তু পাকা শুরু করতেই রাতারাতি সব তলিয়ে গেছে পাহাড়ি ঢলে। তলিয়ে যাওয়া ধান পচে ছড়াচ্ছে অ্যামোনিয়ার পচা দুর্গন্ধ। সেই অ্যামোনিয়ার ঝাঁঝে মরে যাচ্ছে মাছ। আর বিষাক্ত মাছ খেয়ে মরছে পাখি। মাইকিং করে তাই পচা মাছ খেতে নিষেধ করা হচ্ছে এলাকায়।
কামলা হয়ে হাওর ছাড়ছে গৃহস্থ- ছবি: অনিক খান
সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুরের ৫ জনের দলটা তাই জামালগঞ্জের সাজনা ঘাট থেকে উঠেছে ভৈরবগামী লঞ্চে। রাত ১১টায় জলে ভাসা লঞ্চটা সকাল সাড়ে ন’টা নাগাদ পেরিয়েছে মিঠামেইনের ঘাট। অপরের জমিতে কামলা খাটতে নরসিংদীর শিবপুর যাচ্ছে ওরা। জনপ্রতি ২৩০ টাকা ভাড়ায় জায়গা হয়েছে ভূঁইয়া ট্রান্সপোর্টের ছোট্ট লঞ্চটার নিচতলায়।

একে তো ইঞ্জিনের বিকট আওয়াজ, চীৎকার করে কথা বললেও দু’হাত দূর থেকে শোনা যায় না। তারওপর খামাল দেওয়া বাদামের বস্তায় নিচতলাটা পরিণত হয়েছে স্টোর রুমে। বাতাস ভারী হয়ে আছে তেল পোড়া দুর্গন্ধ আর ধোঁয়ায়। মধ্য চৈত্রে শুরু হওয়া আগাম বন্যায় গৃহস্তি হারিয়ে আজ ওদের জীবনাটও যেনো এই ধোঁয়া আর দুর্গন্ধের মতোই বিষাক্ত।

গণেশ নাথের ভাষায়, ধান কাটি, ভাত খাই। কিন্তু হাওরে তো ধানই নাই। এখন আমরা ধান কাটার কামলা।  

তার কথায় তাল মিলিয়ে বিলু দেবনাথের বক্তব্য, আর সপ্তাহ খানিক সময় পাইলেই তো হইতো। এতো দিনে গোলায় তুইলা ফেলতাম। কিন্তু আমাদের হাওর লই গেছে ওই ওপরওয়ালা। গজব পড়ছে ভাইরে। ঘোলা (ঢল) আসছে গজব হইয়া।
কামলা হয়ে হাওর ছাড়ছে গৃহস্থ- ছবি: অনিক খান
রতন সরকারের ভাষায়, আমরার বাড়ির পরিবার কে চালাইতো। তাই শিবপুর যাইতাছি। দেখি কি কাজ পাই। ওইহানে কাজ না পাইলে ঢাকা যামু। গার্মেন্টসে কাম করুম। যে দেশে যে ভাও। জীবনে তো আর সুনামগঞ্জের বাহিরে গেছি না।

ফসল বুনে আজীবন ঘরকুনো হয়ে থাকা মানুষগুলো আজ পেটের দায়ে পরবাসী। ঘোর অনিশ্চয়তা মাথায় নিয়েই হাসানপুর চরের মাটিতে পা রাখে ওরা। ঘোড়াউতরা এখানে চরটাকে ভাঙছে। ঢলের ফুলে ওঠা পানিতে এখন বেজায় তেজ। স্রোতের ঘূর্ণি মনে ভয় ধরিয়ে দেয়। জীবনের ভাঙন প্রতীকী রূপে এখানেও ওদের তাড়া করছে বুঝি।

খেয়া পার হয়ে দীঘির পাড় পৌঁছুলো ভাগ্যান্বেষী দলটা। এখান থেকেই ট্রলার যোগে শিবপুর যাবে ওরা। ওদের জীবনের বাকি গল্পটা আর দেখা হলো না। ওদের ভাগ্যে শেষ তক কি ঘটলো তা জানা যাবে না আর।

সকালে শুরু হওয়া বৃষ্টিটা এখন একটু ধরে এসেছে বটে। তবে বন্ধ হয়নি পুরোপুরি। আকাশ জুড়ে জলভরা মেঘের ছুটোছুটি। বেয়াড়া বাতাস শীতের সূঁচ ফোটাচ্ছে শরীরে। ওদের জীবনটাও কি এই আকাশের মতোই অস্থির আর অন্ধকার!

আরও পড়ুন
** রোদের জন্য হাহাকার
** ঢলের ঘায়ে দাদনের ছিটা
** চোখ তবু হাওরের জলে
** ডুবে যাওয়া ফসলের দ্বীপগ্রাম
** তবু যদি কিছু মেলে
** গরু মরবে ঘাসে
** সামনে এবার মরার বছর
** মাছ নাই রে ভাই
** ধুঁকতে থাকা স্বপ্নও শেষ বৃষ্টিতে

বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।