ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

রোদের জন্য হাহাকার

জাকারিয়া মন্ডল, সিনিয়র আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪০৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০১৭
রোদের জন্য হাহাকার ধানের খলায় ঝিরঝির বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে কৃষক। ছবি: অনিক খান

অষ্টগাম (কিশোরগঞ্জ) থেকে: ছোট্ট পুকুরটায় ভাসছে ১৮ বস্তা ধান। ফুলে ঢোল হয়ে আছে সব ক’টা বস্তা। ক্ষেতের ওপর বাড়তে থাকা পানির সঙ্গে লড়ে তুলে সাকুল্যে ওই ধানটুকুই তুলে আনতে পেরেছিলেন গৃহস্থ। সেটুকু সিদ্ধ করে সবে স্বস্তির স্বাসটা ফেলতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু সেই স্বস্তি সহ্য হয়নি বিরূপ প্রকৃতির।

বৈশাখের শুরুতেই ঘোর শ্রাবণ ভরা করা হাওরের আকাশে ক’দিন ধরেই রোদ ছড়ায়নি সূর‌্যটা। সিদ্ধ করা ধান তাই সম্ভব হয়নি শুকানো।

এক সময় পচতে শুরু করেছে সেদ্ধ ধান। অভিমানী কৃষক তাই বস্তায় ভরে পুকরে ফেলে দিয়েছে সেদ্ধ ধান। পচে গেছে বলেই এভাবে পানির ওপর ভাসছে ধানের বস্তা।

রাস্তার ওপর জড়ো করা খড়ের গাদা কালছে বর্ণ নিয়েছে এরই মধ্যে। শিগগিরই রোদ না পেলে অ্যামোনিয়ার পচা গন্ধ ছড়াতে শুরু করবে ওগুলোও। হাওরজুড়ে এখন তাই রোদের জন্য হাহাকার।
সেদ্ধ ধান বস্তায় ভরে পুকুরে ফেলে দিয়েছে কৃষক।  ছবি: অনিক খান

গত ৫ দিন ধরে অকাল ঢলে ভাগ্য বিড়ম্বিত হাওরবাসীর ভাগ্য নিয়ে আরো ছিনিমিনি খেলছে আকাশ। গত মঙ্গলবার কালবৈশাখীর ডানায় ভর করে আসা বৃষ্টি এ রিপোর্ট লেখা অবধি থেমে থেমে ঝরছে। মাত্র এক সপ্তাহ আগের ৩৩ ডিগ্রি তাপমাত্রা তেজ হারিয়ে নেমে গেছে ২৩ ডিগ্রিতে। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুতে মিশে থাকা আদ্রতা উঠে গেছে ৯৫ শতাংশে। এভাবে আরো দিন চারেক আকাশ গলে বৃষ্টি নামবে বলে দেখানো হচ্ছে আবহাওয়া ওয়েবসাইটে।

সঙ্গে ১২ কিলোমিটার থেকে ২৮ কিলোমিটার পর‌্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে দমকা হাওয়া।

মঙ্গলবারই গুমোট ছিলো কুলিয়ারচরের রাত। সকাল থেকেই আকাশ গলে বৃষ্টি হয়ে ঝরতে শুরু করেছিলো। বুধ আর বৃহস্পতিবার রাতে বাতাসের পিলে চমকানো সাঁই সাঁই শব্দে অজানা ভয় ভর করেছিলো ইটনার জেলা পরিষদ ডাকবাংলোয়। দিনভর ছিলো ঝিরঝির বৃষ্টির দাপট। ধনু নদীতে ছুটে চলা লঞ্চেও হানা দিয়েছে বৃষ্টি।
হাওরের আকাশে এখন দিনভর এমনই মেঘের দাপট। ছবি: অনিক খানশুক্রবার রাতে মিঠামইনের জেলা পরিষদ ডাকবাংলোয় বাতাস অতোটা বেয়াড়া ছিলা না বটে, কিন্তু শনিবার (২২ এপ্রিল) সকাল থেকেই মুষলধারায় ঝরতে শুরু করেছিলো ফের। তারপর একটু কমে ধনু, ঘোড়াউতরা আর মেঘনার জলের সঙ্গে সারাদিন কোরাস গেয়েছে আকাশ গলা বৃষ্টির ফোটা। কান্নার রেশ চালু ছিলো রাতেও।

কখনো সখনো সূর‌্যটা মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দিয়েছে বটে, কিন্তু বারবারই তার সামনে এসে বাগড়া দিয়েছে বেয়াড়া মেঘের দল। এমন মেঘ বৃষ্টির খেলায় ডুবে যাওয়া ধান তুলতে গিয়ে ফিরে এসেছে কৃষক।    

অষ্টগ্রামের ইকুরদিয়া ঘাটে শরীরে গামছা জড়িয়ে ডুবন্ত ধানক্ষেতের দিকে তাকিয়ে থাকা আব্দুল আলীর ভাষায়, রোদ নাই, রোদ নাই। কোথাও কোমর পানি, কোথাও বুকও ডোবে। তারওপর বাতাস। শীত করে।

একে তো ঠাণ্ডা পানি, তারওপর ডুবে ডুবে ধান তোলার খরচ পড়ছে বেশী।    
এক হয়ে গেছে হাওরের ফুঁসে ওঠা নদী আর মেঘলা আকাশ।  ছবি: অনিক খানপূর্ব অষ্টগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য শহীদুল ইসলাম বলেন, রোদ না ওঠায় বিলগুলোতে এখন ঠাণ্ডা পানি। কৃষকরা তাই জমিও কাটতে পারছে না।

আব্দুল কুদ্দুসের বক্তব্য, একটানা আধা ঘণ্টা কি এক ঘণ্টা ডুবে ডুবে ধান তোলা যায়। তারপর ঠাণ্ডায় শক্ত হয়ে যাওয়া শরীর নিয়ে ফিরে আসা লাগে ডাঙ্গায়। রোদ না থাকায় সেই ধানও তো পচে যাচ্ছে। কাঁচা ধান ফেলে রাখলে গাছ গজাবে। সেদ্ধ করলে ধরবে পচন। হাওরবাসীদের তাই এখন উভয় সঙ্কট।

এই সঙ্কটের জের যে শুধু কৃষকের জীবনেই বাঁধা পড়ে থাকছে তা নয়। পুরো পরিবেশেই ধানের জন্য আকুলতা।

ইসলামপুর দারুল সুন্নাহ হাফেজিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক রফিকুল ইসলামের ভাষ্য, এ ধানের সহযোগিতায় আমাদের মাদ্রাসাও চলে। এখানে ৪০ ছাত্র আছে হেফজখানায়। কিন্তু এবার এক মুঠো ধানও আমরা পাবো না। রোদ এলে তবু কিছুটা রক্ষা হয়। আমাদের ভাগ্য এখন ওই আকাশের মতোই মেঘাচ্ছন্ন।

বাংলাদেশ সময়: ১০০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০১৭
জেডএম/

আরও পড়ুন

** ঢলের ঘায়ে দাদনের ছিটা
** চোখ তবু হাওরের জলে
** ডুবে যাওয়া ফসলের দ্বীপগ্রাম
** তবু যদি কিছু মেলে
** গরু মরবে ঘাসে
** সামনে এবার মরার বছর
** মাছ নাই রে ভাই
** ধুঁকতে থাকা স্বপ্নও শেষ বৃষ্টিতে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।