ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

এখনো চিকিৎসার অপেক্ষায় নিলুফা

উর্মি মাহবুব, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫২ ঘণ্টা, এপ্রিল ২১, ২০১৭
এখনো চিকিৎসার অপেক্ষায় নিলুফা এখনো চিকিৎসার অপেক্ষায় নিলুফা/ছবি: রানা

ঢাকা: সাভারের শাহীবাগ এলাকার আদর্শ স্কুল রোড। নিলুফা কোথায় থাকেন জানতে চাইলেই এগিয়ে আসেন বেশ কয়েকজন, ‘আহারে বেচারি পঙ্গু হইয়া ঘরে বসে আছে।’

আদর্শ স্কুল রোডে একটি বাড়িতে এক রুমে স্বামী ও একমাত্র ছেলেকে নিয়ে থাকেন নিলুফা। ক্র্যাচে ভর দিয়ে হাঁটছেন।

এখনো পায়ে ভবনের বিমের আঘাতের চিহ্ন দগদগ করছে। ছোট্ট রুমের এক কোটে খাটপাতা। তার গা ঘেঁষে রয়েছে শোকেস আর টেবিল। খাটে বসে দুই হাত দিয়ে টেনে তুলেন পা। এই খাটেই এখন দিন কাটে নিলুফার।

রানা প্লাজার ধ্বংসস্তুপে দু’টি মরদেহর নিচে ছিলেন প্রায় ৯ ঘণ্টা। সেখান থেকে উদ্ধারতো হয়েছিলেন, কিন্তু আজও চিকিৎসার অপেক্ষায় দিন কাটছে নিলুফার।

জীবনযুদ্ধে প্রতি মোড়ে জয়ী হওয়া নিলুফা আজ যেন সবার বোঝা। মানিকগঞ্জে জন্ম নিলুফার। ১৭ বছর বয়স থেকে কারখানায় কাজ করতো নিলুফা। নিজের কর্মদক্ষতায় প্যানটম অ্যাপারেলে পদন্নোতি পেয়ে হয়েছেন সুইন অপারেটর। নিজের সংসারে যেমন ছিলো নিলুফার অবদান, ঠিক তেমনি মায়ের সব খরচও চালাতেন তিনিই। কিন্তু আজ তার দিনকাটে বস্তির একটি ঘরে বসে।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিলের কথা মনে পড়লে আজও আঁতকে উঠেন নিলুফা। ২৪ এপ্রিল মালিকপক্ষ জোর করে পাঁচতলায় উঠান নিলুফাকে। কাজ শুরু করার কিছুক্ষণ পরেই ভবন যেন নিচের দিকে যাচ্ছে, বুঝতেই এদিক ওদিক ছোটোছুটি শুরু করে শ্রমিকরা। নিলুফাও সিঁড়ির দিকে দৌড়ানো চেষ্টা করে। কিন্তু পৌঁছানোর আগেই দু’জন শ্রমিক পড়েন তার ওপর। তারওপর ভবনের বিম। বিমের এক অংশের পড়ে সরাসরি নিলুফার পায়ের ওপর।

চারদিকে শুধুই যেন অন্ধকার। কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যান নিলুফার ওপরে থাকা দুই শ্রমিক। একজন মারা যাওয়ার আগে বলেন, আপা আমি আর বাচমু না। আপনি বাইচা থাকলে আমার মা বাপের কাছে লাশটা পৌঁছায়া দিয়েন। তারপর আর কিছু মনে নেই নিলুফার। জ্ঞান ফিরে চোখ মেলে নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পান হাসপাতালের বিছানায়।  

ইতোমধ্যে ডাক্তার নিলুফার পা কেটে ফেলার রায় দিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু পা কেটে ফেলারও টাকা নেই। একবার অপারেশন করতে খরচ হয়েছে ৭০ হাজার টাকা। দুর্ঘটনার পর কিছুদিন পর্যন্ত ফ্রি চিকিৎসা পেলেও এখন তা বন্ধ। সরকার ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৩ লাখ টাকা দিয়েছিলো, তার সিংহভাগই খরচ হয়ে গিয়েছে অপারেশন আর ওষুধপত্রে। স্বামী শহীদুল ইসলাম একজন সাধারণ রং মিস্ত্রী। তার আয়ের দু’বেলা দু’মুঠো খাবার যেখানে জোগাড় করা কঠিন সেখানে চিকিৎসার জন্য টাকা খরচ আজ কেবলই বিলাসিতা।  

বিনা চিকিৎসায় ধীরে ধীরে যেন মৃত্যুর দিকে হাঁটছেন এই জীনযোদ্ধা নারী। ‘আর হয়তো বেশিদিন বাচমু না। শুধু পোলাডারে নিয়া টেনশন। আমি না থাকলে পোলাডার কি হইব। যখন ভবন ভাইঙ্গা পড়ছিলো তখনো শুধু ছেলেটার কথাই মনে পড়তাছিলো। কিন্তু এহন মনে হয় মইরা গেলেই ভালো হইত। তাহলেই ১০ লাখ টাকা পাইত পোলা। ওর ভবিষ্যত নিশ্চিত হইত। কিন্তু এখনতো কোনো রকম খায়া না খায়া দিন কাটতাছে।  

এমন হাজারো অনিশ্চয়তা দিন কাটছে নিলুফার শাহীবাগের বাড়িটিতে। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ধসে পড়ে সাভারের রানা প্লাজা। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয় এটি। এই দুর্ঘটনায় নিহত হন ১ হাজার ১৭৫ জন। আহত হন প্রায় ২ হাজার শ্রমিক।  

বাংলাদেশ সময়: ২১৪৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ২১, ২০১৭
ইউএম/এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।