ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

হাওর বধূদের মুখেও আঁধার!

এম আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩১ ঘণ্টা, এপ্রিল ২১, ২০১৭
হাওর বধূদের মুখেও আঁধার! হাওর বধূদের মুখে আঁধার- ছবি- অনিক খান

ইটনা হাওর (কিশোরগঞ্জ) থেকে: বোরো ধানের চনমনে গন্ধে এবার মাতোয়ারা হওয়ার সুযোগই হয়নি হাওরের বধূদের। সোনা রাঙা ধানের বাম্পার ফলনে আন্দোলিত বাড়ির গৃহকর্তার পাশাপাশি ধান সেদ্ধ, শুকানো আর মজুদের কাজ নিয়ে পুরো মাত্রায় ব্যস্ত থাকার কথা ছিল তাদের। 

কিন্তু সেই বধূদের মুখজুড়ে এখন নিকষ কালো আঁধার। কাঙ্ক্ষিত ফসল গোলায় তুলতে না পারার কষ্ট কেড়ে নিয়েছে মুখের অনাবিল হাসি।

 

আগাম বন্যায় ডুবে যাওয়া ফসলের সঙ্গে সঙ্গে তাদের জীবনের সঙ্গী যেন নীরব কান্না। পানির ঢেউ আর আওলা বাতাসে কৃষক বধূদের ভারী মুখের চেহারাই ফুটে হাওরের ইটনা উপজেলার সহিলা গ্রামে।

কয়েক দফা চক্কর দিয়েও রোদে পায়ের পাতা ধানে ডুবিয়ে নাড়া কিংবা বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কুলোয় করে ধানের ‘চুছা’ ছাড়ানোর অনবদ্য চিত্রকল্পও এখানে অবাস্তব।  

অবশ্য এখানকার ঘোষ পাড়ায় বাড়ির চৌহুদ্দিতে গরু দিয়ে কয়েক ছটাক ধান মাড়াইয়ের দৃশ্য ক্যামেরায় ধরা পড়লো।  

ধার-কর্জ করে খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন বোরো ফসল অকাল বন্যায় বিলীন হওয়ায় কর্মহীন হাওর বধূ স্বর্ণালী ঘোষ। রয়েছেন মানসিক অশান্তিতে। হাওরে অথৈ পানিহাওরে নেমে আসা ভয়ানক দুর্যোগ চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কী বা করার আছে তার। কথা বলতে গিয়ে কান্নার দলা পাকায় তার কণ্ঠস্বরে।  

প্রায় ২০ একর জমি বর্গা নিয়ে চাষ করেছিলেন তার স্বামী। এ জমি থেকে যেখানে দেড় থেকে দুইশ’ মন ধান পাওয়ার কথা সেখানে জুটেছে সাকুল্যে ১০ কী ১৫ মণ। এমন বাস্তবতায় সুখ যেন অধরাই থেকে যাচ্ছে তার আপন ভুবনে।  

তার মতোই প্রতিভা ঘোষ, শেফালী ও অর্পনা ঘোষের মনেও সুখ নেই। উৎসবের রঙ নেই। হাওরের সর্বগ্রাসী আচরণে এমন ফসলহানির ঘটনা অতীত জীবনে দেখেননি।  

বছরের একমাত্র ফসল হাওরের বুকে তলিয়ে যাওয়ায় ভবিষ্যত জীবনের স্বপ্নটাকেও দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে।  

এমন যন্ত্রণার যাতাকলেই কী-না তাদের সময় ফুরোচ্ছে না। আর কাটবেই বা কী করে? সর্বনাশা এ চৈত্র মাসই যে কেড়ে নিয়ে গেছে সব। প্রধানমন্ত্রীর কৃষি ঋণের সুদ মওকুফ করার ঘোষণা সাময়িক আনন্দ দিলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।  

স্বপ্নের ফসল হারিয়ে একেবারে পথে বসার দুশ্চিন্তা তাদের কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।  

সেই দুঃখবোধেই হয়তো গজর গজর ভঙ্গিতে শেফালী ঘোষ উচ্চারণ করলেন-উপরওয়ালা ভাগ্যে দুর্গতি লিখে দিয়েছেন। কার সাধ্য আছে ঠেকানোর।  

সুদিন থাকলে বাড়ির আঙিনা নতুন ধানের ভরে উঠতো। আমরা উঠোনে ধান শুকাতাম। ঘর থেকে বের হতো ধান ভানার শব্দ। ধরাবাঁধা এ নিয়মের বদলে তাদের জীবনে নেমে এসেছে শনির দশা।  

ধনু নদীর অববাহিকায় সহিলা গ্রামের পাশেই ঘোষপাড়া। এ পাড়ার এক নারী রুমা রাণী ঘোষ। নদী থেকে তুলে আনা কয়েক ছটাক ধান মাড়াই করাচ্ছিলেন গরুর পালে।  

খানিক দূরেই কান্নার জলের নিদারুণ ঢেউ তুলেছেন আরেক পল্লীবধূ। খাদ্য সঙ্কটে থাকা গরুর পাল সুযোগ বুঝে রুমা রাণীর শেষ সম্বল এ ধানটুকুও যেন সাবাড় করতে বসেছে! 

‘সবই তো গেছে। আমরা না হয় না খেয়ে মরবো। অন্তত গরুই খাইয়া বাঁচুক’ এবার অস্ফুট কণ্ঠে উচ্চারণ রুমা রাণী’র। তার কন্যা জোনাকী রাণী ঘোষ স্থানীয় ইটনা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে চলতি বছর এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে।  

অনাহারের কষ্ট এখনো শুরু না হলেও হাওরের ভয়ানক দুর্যোগে দিশেহারাই মনে হলো তাকে। বলছিলেন, হাওরের মানুষ এখন নিঃস্ব। শুধুমাত্র ভিটেমাটি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। ’

বলতে বলতেই যেন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তার আঁধারে ঢেকে গেলো এ তরুণীর মুখও।  

বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ২১, ২০১৭ 
এমএএএম/জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।