ধনু নদীর পাড়ে খণ্ডাকার সবুজ দ্বীপটায় অসহায় গরুর পালের মাথার ওপরে কালো মেঘ ঘনিয়ে আসছে, সবে শুরু হওয়া বৈশাখেই যেনো ভর করেছে শ্রাবণ। ডুবে যাওয়া ধান ক্ষেতের ওপরে টলোমলো পানির দিগন্ত ছুঁয়ে কি বলতে চাইছে কালো আকাশ।
ওই কালোর ছায়া কি গরুর পালের ওপরও পড়লো! ওদের রক্ষক মানুষের ললাটেই তো আজ ঘোর অমানিশা। অসহায় বন্যায় দিশেহারা মনিবরা। ওই আকাশ তো আজ ওদেরই ভাগ্যের প্রতিবিম্ব।
এরইমধ্যে দাম পড়ে গেছে গরুর। জলে ডোবা সময়টায় যে খড় তাদের বাঁচিয়ে রাখে সেই খড়ও তো আজ কয়েক হাত পানির নিচে। ধানও তো গেছেই। গাছগুলোও পচতে শুরু করেছে এরইমধ্যে। ওই পচা ধান আর পচা খড় আর কোনো কাজে আসবে না মানুষ বা গবাদিপশুর।
হাওর এলাকায় এবার গবাদি পশুর খাদ্য সঙ্কট তাই অবশ্যম্ভাবী। ভারতের পাহাড় থেকে নেমে আসা অকাল ঢল এবার হাওরের পুরো জীবনচক্রকেই অনিশ্চিত উদ্বেগের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
নূর মিয়ার ভাষায়, গরু বান্ধা পড়ে আষাঢ় মাসে। এবার মধ্য চৈত্রেই বান্ধা পড়ছে। তাই মানুষ মরবে ভাতে। আর গরু মরবে ঘাসে।
৮৫ হাজার টাকায় কেনা গরু এখন ৫৫ হাজারেও কেউ কিনতে চাইছে না জানিয়ে তিনি বলেন, গরু খায় খেড় (ধানের শুকনো গাছ)। এবার খেড়ও নাই। ডুব দিয়া ধান গাছ কাইটা আনলে খালি চিটা আর চিটা (মরা ধান)। খইল-ভুষি কিনতে যে টাকা লাগে তা কই পামু?
যুবক নারায়ণ ঘোষের মতে, বিরি ২৮ তুইলা আনলে প্রথম প্রথম তো ৪ আনা ধান পাওয়া গেছে। বাকি ১২ আনাই ছিলো চিটা। কিন্তু এখন তো সবই পইচা গেছে। গরুর খাবার সব শ্যাষ।
বাস্তবিকই এবার মানুষের পাশাপাশি গরুরও খাদ্য সঙ্কট তৈরি হচ্ছে হাওরে। এ সঙ্কট থেকে উত্তোরণের কোনো উপায় এখনো পায়নি হাওরের কৃষক। তারওপর নতুন করে শুরু হয়েছে বৃষ্টি।
যদিও একটাও বসত ঘর ডোবেনি এখানে। ভেসে যায়নি কোনো গবাদিপশু। বরং ভারতীয় ঢলের পানিতে আরো সহজ হয়েছে জলপথের যোগাযোগ। তবু এটা বন্যা। প্রচলিত বন্যার চেয়ে এই বন্যার রূপ আরো ভয়াবহ।
এ বন্যার তর্জন গর্জন নেই, তবে মোক্ষম কোপটা মারে ঠিকই। ঘাসের অভাবে এবার হাওরের গবাদি পশু পালন দুরূহই হয়ে উঠলো বটে।
ইটনার ধান শ্রমিক আবুল বাশার আর বারেক আলীর কথায়, গরুর অবস্থা এবার খুব খারাপ। ঘাস নাই, খাদ্য নাই।
৫ নম্বর বাদলা ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান গণি ভূঁইয়া বলেন, হাওরের গরু হাওরেরই ঘাস আর খড় খেয়ে বাঁচে। কিন্তু এবার তো ধানই তোলা গেলো না। খড় পাবে কোথায়? আগাম বন্যায় ক্ষতির তালিকায় হাস-মুরগিও আছে। কিন্তু গরুই বেশী ক্ষতিগ্রস্ত। অনেক গরু বিক্রি হয়ে গেছে পানির দরে। ৬০ হাজারেরটা ২৫/৩০ হাজারে। খাদ্য না পেলে গরু পালবে কিভাবে?
ইটনা উপজেলা চত্বরে, হেলি প্যাডের ওপরই ডজন দুই গরু-ছাগল ঘাস খেয়ে যাচ্ছে আপনমনে। ওদের এখন বিচরণ করার কথা হাওরে। কিন্তু অকাল বন্যায় এখন নিজ ভূমে পরবাসী ওরা। সামনে যে ওদের কপালে ভয়াবহ খাদ্য সঙ্কট নেমে আসছে তা কি করে বুঝবে এই অবলা গরু-ছাগলের পাল!
আরও পড়ুন
** সামনে এবার মরার বছর
** মাছ নাই রে ভাই
** ধুঁকতে থাকা স্বপ্নও শেষ বৃষ্টিতে
বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০১৭
জেডএম/