‘এখন ধানগাছ তুলছি গরুর খেড়ের (খড়ের) জন্য। স্ত্রী ও ছয় কন্যাসন্তান নিয়ে চলাই এখন দুষ্কর ।
হাওরে পাহাড়ি ঢল আর বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। ভেসে উঠছে কিছু কিছু ধানী জমি। কোথাও শীতল পাটির মতো বিছানো ধান গাছ, কোথাও বা দাঁড়িয়ে। দাঁড়িয়ে থাকা ধানগাছে ধান নেই, আছে শুধু ছোছা(খোসা)বা চিপটি। ভেসে ওঠা এক ফসলি জমিতে ফের খেত করার (চাষ করা) সক্ষমতা একদমই নেই কৃষকদের।
হাওরে চিত্রই বলে দেয় কৃষকদের দু:খ দুর্দশার কথা। বাতাসে পচা ধানের দুর্গন্ধ। ধানপচা পানিতে মরছে মাছ ও হাঁস। এর আগেও এভাবে বহুবার পানির নীচে ধান গেছে, কিন্তু মাছ-হাঁস মরেনি। এলাকাজুড়ে বলাবলি হচ্ছে, নিশ্চয়ই উজান থেকে আসা পানিতে বিষাক্ত রাসায়নিক পানিতে ছাড়া হয়েছে।
এদিকে, চারণভূমি ও ধান খেত তলিয়ে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে গোখাদ্যের সংকট। পশুপালনও দায় হয়ে পড়েছে । এরই মধ্যে নিজেদের গরু বিক্রি করে দিয়েছেন অনেকে।
বিশ্বম্ভরপুরের ষোলাকাবাদ বাদেরটেক গ্রামের মো. আন্তর আলীর দু’টি হালের গরু ছিলো। অন্যসময়ে হলে একেকটি ৬০/৭০ হাজার টাকায় বিক্রি হতো। গোখাদ্যের অভাবে একেকটি গরু ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করতে হয়েছে। তা দিয়ে এনজিওর ঋণ শোধ করেছেন। সরকারের কাছে তার আর্তি, ত্রাণ যদি আসে, তার মতো প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের যেনো দেওয়া হয়। নেতাদের পেটে যেন না যায়!
সারা বছর কী খাবেন এটাই বড় চিন্তা কৃষকদের। কেউ কেউ বিকল্প আয়ের পথ খুঁজছেন। দক্ষিণ সুনামগঞ্জের পাগলা ইউনিয়নের দামুদরতকি গ্রামের কৃষক আরজন আলী। দুটি এনজিও থেকে ৪০ হাজার এবং ধান দেওয়ার শর্তে টাকা ঋণ এনে ৩৬ কেদার (১ হাজার ৮০ শতক) জমি বর্গাখেত করেছেন। স্বপ্ন ছিলো ধান পেয়ে ঋণ শোধ করবেন। সন্তানদের লেখাপড়া করাবেন, সংসার চালাবেন। তার সব স্বপ্ন তলিয়ে গেছে পানির নীচে। বর্গাচাষি হিসেবে প্রতি কেদারে জমি-মালিককে ৫ মন ধান দেওয়ার কথা ছিল তার।
একই গ্রামের মো. হারুন মিয়া তালুকদার বলেন, গ্রামের মধ্যে মনে হয় আমিই ৪০ কেদার (১ হাজার ২শ’ শতক) জমি খেত (চাষ) করেছি। মাত্র ৫ কেদার (১৫০ শতক) বন্যার পানি থেকে রক্ষা পেয়েছে। তাও আবার ফসল খারাপ হয়ে গেছে। পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত না হলে অন্তত হাজার মন ধান পেতেন। তাঁরই মতো গ্রামের হাজার হাজার কৃষক এক মুঠো ধানও ঘরে তুলতে পারেননি।
পাশ্ববর্তী মোহাম্মাদপুরের হাজি সাহাব উদ্দিন বলেন, আমি ৭০ কেদার (২ হাজার ১শ’ শতক) জমিতে ধান ক্ষেত করে এক কাস্তেও ঘরে তুলতে পারিনি। এরচেয়ে কষ্ট আর কি হতে পারে।
টাঙ্গুয়ার হাওর, শনির হাওর, বিশ্বম্ভরপুরের কড়চার হাওর, সদর উপজেলার দেখার হাওর, জগন্নাথপুরের নলুয়ার হাওরসহ ছোটবড় প্রায় ৩০টি হাওরের দুই লক্ষ ৫৭ হাজার ২শ’ ৮৯ হেক্টর বোরো ফসল পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। এ অঞ্চলে ১ লাখ ৭১ হাজার ৮৬৭ জন কৃষক সব ফসল হারিয়েছেন। এই কৃষকদের এখনো প্রণোদনা দেওয়া হয়নি। জানালেন সিলেট বিভাগীয় কৃষি সম্প্রসারণ উপ-পরিচালক মামুনুর রশিদ।
ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জাল হোসেন মায়া সুনামগঞ্জে অবস্থান করছেন। এদিন তিনি কয়েকটি দুর্গত এলাকায় ত্রাণের চাল বিতরণ করেন। সন্ধ্যায় জেলা প্রশাসকসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক বসেন।
বাংলাদেশ সময়: ২২১৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৯, ২০১৭
এনইউ/জেএম