ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

ধুঁকতে থাকা স্বপ্নও শেষ বৃষ্টিতে

জাকারিয়া মন্ডল, সিনিয়র আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৯, ২০১৭
ধুঁকতে থাকা স্বপ্নও শেষ বৃষ্টিতে প্রবল বর্ষণে স্নাত হাওড়ের জনপদ; ছবি-অনিক খান

ইটনা (কিশোগঞ্জ) থেকে: ‘বৃষ্টিতে আর ভয় কি! সব তো গেছেই।’ এটুকু বলেই খাটের ওপরে আরো গ্যাঁট হয়ে বসেন নূর আলী। বাইরের মুষল বৃষ্টিতে ভিজে এসে এই মাত্র লুঙ্গি-গেঞ্জি পালটানোর কথাটাও যেন বেমালুম ভুলে গেছেন। কিন্তু তার এমন উদাসীন কথায় চুপ থাকার বান্দা নন পোড় খাওয়া তায়ের আলী।

নূরের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, ‘ভয় আছে। ভয় আছে।

ধান যেটুকু ছিলো আজকের বৃষ্টিতে সেটুকুও শেষ। ’ তার হাতে সারের বস্তা কেটে বানানো একটা ব্যাগ। ভেতরে টিফিন বাটিতে খাবার। কাস্তেটা নৌকাতেই ফেলে কোনোমতে এসে ঠাঁই নিয়েছেন নূর আলীর এই চালাঘরে। বিকেল চারটাতেও দুপুরের খাবারের বাটি খোলা হয়নি তার।

হতাশ কণ্ঠে বললেন, বোরায় বোরায় (ডুবে ডুবে) ধান কাটতে গেছিলাম বিলে। হঠাৎ আকাশ নামলো। সব থুইয়া ছুইটা আইলাম। কালো মেঘে ঢাকা হাওড়ের আকাশ; ছবি- অনিক খান

কোথাও কোথাও এক কি দু’চিলতে জমিতে ধানগাছের যেটুকু ডগা এখনো পানির ওপর মাথা তুলে নীরবে প্রকৃতির সঙ্গে যুঝছিলো, সেগুলোই বুঝি টার্গেট ছিলো বৃদ্ধ তায়েরের। কিন্তু আকাশের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে তাকে।

সকাল থেকেই মুখ গোমড়া করে থাকা আকাশ থেকে টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছিলো সেই চামড়াঘাট জেটিতেই। কাঁদতে থাকা সেই আকাশ মাথায় নিয়েই ধনু নদীতে ভেসেছে স্পিডবোট।

ভারতীয় পাহাড়ি ঢলের পানিতে হাজার হাজার হেক্টর ফসল তলিয়ে না গেলে এমন আকাশকে বোধ করি রোমান্টিক বলতে দোষ হতো না। কিন্তু এ আকাশ অন্য আকাশ। এ আকাশ থেকে ঝরে পড়া পানিতে মিশে আছে স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনা। বৃষ্টির প্রতিটা ফোটা যেনো পেরেক ঠোকার যন্ত্রণা ছড়াচ্ছে ভাগ্য বিড়ম্বিত কৃষকের বুকে।

অর্ধেক পথ পেরুনোর আগেই পশ্চিম আকাশে ভর করলো নিকষ অন্ধকার। এতো কালো আকাশ সচরাচর চোখে পড়ে না। গোটা হাওরজুড়েই যেনো আধিভৌতিক এক প্রকৃতি জেঁকে বসতে শুরু করেছে। দক্ষিণ-পশ্চিমের মৌসুমী বায়ু গতি পালটে বইতে শুরু করেছে পূর্ব থেকে। দমকা বাতাস বুঝি এই উল্টে দিলো ছোট্ট স্পিডবোট। মেঘের গুড়গুড় কানে বাজতে থাকলো বিকট আওয়াজ হয়ে। চোখের সামনে নাচতে শুরু করলো বিজলি। যেনো হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে।

কোনোমতে ইটনার মাটিতে নামতে না নামতেই শুরু হলো ‍মুষল বৃষ্টি। মিনিট পাঁচেকের হাঁটা দূরত্বের জেলা পরিষদের ডাক বাংলোটাকে মনে হলো অনেক দূর। অগত্যা আশ্রয় জুটলো নূর মিয়ার টিনের চালায়। তায়ের আলীও দৌড়াতে দৌড়াতে আশ্রয় নিলেন সেখানে। প্রবল বর্ষণে স্নাত হাওড়ের জনপদ; ছবি- অনিক খানএরপর কেবল ফসল ডোবার হতাশা আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের গল্প। টিনের চালে ঝেপে বৃষ্টি পড়ার ছন্দোবদ্ধ শব্দ হয়ে উঠলো সব হারানোর হাহাকার। মেঘের আদল নিয়ে দমকা বাতাসে ভাসতে থাকা জলের কণা যেন হাওরবাসীর ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলারই চাক্ষুস মহড়া।

অথৈ জলের উত্তাল সাগর হয়ে ওঠা অসংখ্য বিলের এখানে ওখানে ঘাসবনের আদল নিয়ে যেসব ধান এখনো ডগা দোলাচ্ছিলো, সেসব এরই মধ্যে পানির নিচে আত্মসমর্পণ করতে শুরু করেছে।

বেশিরভাগ ধান তো টানা ক’দিন পানির নিচে থেকে পচেই গেছে। যে কয়টা এখনো পানির ওপরে ভাসছিলো এবার সে ক’টাও শেষ। বুধবারের (১৯ এপ্রিল) এই বৃষ্টিটা ধসিয়ে দিলো সব। হাওরের ভেতরে ডুবিয়ে দিলো কৃষকের শেষ স্বপ্নটুকু।

*মাছ নাই রে ভাই

বাংলাদেশ সময়: ১৮২০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৯, ২০১৭
জেডএম/আরআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।