ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

মানহীন বিদেশি কাগজ আমদানিতে সহায়তা এনসিটিবির!

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৫২ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০১৭
মানহীন বিদেশি কাগজ আমদানিতে সহায়তা এনসিটিবির!

ঢাকা: বিদেশি কাগজ আমদানি সরকার নিরুৎসাহ করলেও এক্ষেত্রে উৎসাহিত করছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। দেশি বেশ কিছু কাগজের মিল মানসম্মত কাগজ উৎপাদন করলেও তাদের কাছ থেকে না কিনে আমদানি করা নিম্নমানের কাগজ কিনছে তারা। এতে বিপাকে পড়েছেন দেশীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।

সেই ধারাবাহিকতায় এবারও আমদানি করা আর্ট কার্ড পেপার কেনার জন্য জোর চেষ্টা চালাচ্ছে এনসিটিবি।

মঙ্গলবার (২৮ মার্চ) এনসিটিবি মাধ্যমিক স্তরের এক কোটি ২৭ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য প্রায় ১৮ কোটি বই ছাপার কাগজ কিনতে দরপত্র উন্মুক্ত করে।

এই দরপত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ২৩ হাজার ৭০০ টন কাগজ কেনা হবে। এর মধ্যে ২১ হাজার ৫শ’ টন হোয়াইট প্রিন্টিং পেপার এবং দুই হাজার ২শ’ টন আর্ট কার্ড পেপার।

এনসিটিবির একটি সূত্রে জানা গেছে, হোয়াইট প্রিন্টিং পেপার এবার ২২টি লটে এবং আর্ট কার্ড পেপার তিনটি লটে সরবরাহ করবে কাজ পাওয়া কাগজকলগুলো। তবে মঙ্গলবার দরপত্র উন্মুক্ত করার পর দেখা যায়, হোয়াইট প্রিন্টিং পেপার সরবরাহের জন্য দরপত্রে অংশ নেওয়া এমন একটি কোম্পানি সর্বনিম্ন দরদাতার তালিকায় আছে যারা একেবারেই নতুন। আগে এ ধরনের কাগজ সরবরাহের কোনো অভিজ্ঞতা তাদের নেই। আর আর্ট কার্ড পেপার সরবরাহের জন্য এমন একটি কোম্পানি সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে, যারা এই কাগজ উৎপাদনই করে না। অথচ সর্বনিম্ন দরদাতার চেয়ে মাত্র ২শ’ ২০ টাকা বেশি দর দিয়েছে একটি দেশীয় কাগজকল, যারা দেশেই এই আর্ট কার্ড পেপার উৎপাদন করে।

এ খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এনসিটিবি উৎপাদনকারীর চেয়ে আমদানিকারককেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। অথচ আর্ট কার্ড পেপারের জন্য যে কোম্পানি সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে তারা বৈধভাবে কাগজ আমদানি করলে কোনোভাবেই এই দরে কাগজ সরবরাহ করতে পারবে না। এর পরও যদি এনসিটিবি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকেই আর্ট কার্ড পেপার সরবরাহের আদেশ দেয় তাহলে তাদের অবশ্যই নিম্নমানের কাগজ দিতে হবে। আর সরকারি রাজস্বও ফাঁকি দিতে হবে।

বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, আমাদের দেশে যারা আর্ট কার্ড পেপার উৎপাদন করছে তাদের কাজ না দিয়ে আমদানিকারককে কাজ দেওয়াটা কোনোমতেই ঠিক হবে না। কারণ আমদানিকারকরা কোনোমতেই তাদের মান ঠিক রাখতে পারে না। তারা স্যাম্পল ভালো দিলেও পরে নিম্নমানের কাগজ সরাবরাহ করবে। তাই টাকা সামান্য বেশি হলেও উৎপাদকারীদের কাছ থেকে কাগজ কেনা উচিত। এতে এনসিটিবিরও সঠিকভাবে মান যাচাই করার সুযোগ থাকবে। আর যেসব কাগজকল একেবারেই নতুন তাদের কাছ থেকেও কাগজ কেনা ঠিক না। কারণ তাদের পক্ষে শিডিউল অনুযায়ী কাগজ সরবরাহ কষ্টকর হয়ে পড়বে।

প্রতিবছর বিনামূল্যে বিতরণের বই মুদ্রণ করতে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টন কাগজ লাগে। এর মধ্যে শুধু মাধ্যমিকের বই ছাপার জন্য কাগজ কিনে দেয় এনসিটিবি। আর প্রাথমিক, প্রাক-প্রাথমিক, দাখিল, ভোকেশনালসহ অন্যান্য স্তরের বইয়ের জন্য মুদ্রণকারীরাই কাগজ কিনে বই সরবরাহ করে। গত বছরও এনসিটিবি প্রতি টন হোয়াইট প্রিন্টিং পেপার কিনেছে ৭৬ হাজার থেকে ৭৯ হাজার টাকার মধ্যে। অথচ এ বছর এর চেয়েও মানসম্মত কাগজের দর জমা পড়েছে ৬৩ হাজার থেকে ৬৬ হাজার টাকার মধ্যে।

সংশ্লিষ্টরা জানায়, এত দিন প্রতি টন ৭৯ হাজার টাকা পর্যন্ত দরে কাগজ কিনলেও বাস্তবে এসব বেশির ভাগ কাগজের সর্বোচ্চ দাম টনপ্রতি ৬০ হাজার টাকা। এত দিন কম দামের কাগজ বাড়তি দর দেখিয়ে এনসিটিবিকে সরবরাহ করায় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের অবৈধ মুনাফা হতো বছরে ৮০ থেকে ৯০ কোটি টাকা। ওই বাড়তি টাকা যেতো এনসিটিবি কর্মকর্তা ও কতিপয় মুদ্রণকারীর পকেটে। বেশিরভাগ কাগজই ছিল নিম্নমানের, মূলত নিউজপ্রিন্ট।

রিসাইক্লিং কাগজের পাল্প দিয়ে তা তৈরি করা হয়। আর যাদের মান নিয়ন্ত্রণ করার কথা তাদেরও বাস্তবসম্মত কোনো অভিজ্ঞতা নেই। ফলে আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে তারা নিম্নমানের কাগজকেই বৈধতা দিয়েছে।

এনসিটিবি কাগজ কেনার ক্ষেত্রে সরকারের ক্রয় নীতিমালাও মানে না।

জানা যায়, লেখা ও ছাপার কাগজের জন্য বিএসটিআই থেকে সিএম লাইসেন্স গ্রহণ বাধ্যতামূলক করেছে সরকার। বিএসটিআই অর্ডিন্যান্স ৩৭ (১৯৮৫) এবং বিএসটিআই (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট ২০০৩ অনুযায়ী সিএম লাইসেন্স ছাড়া কাগজ-পণ্যের বিক্রয়, বিতরণ ও বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন প্রচার নিষিদ্ধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু এত দিন বিএসটিআইয়ের সনদবিহীন মিল থেকেই কাগজ কিনেছে এনসিটিবি। এতে সরকারও বড় অঙ্কের রাজস্ব হারিয়েছে। সরকারি ক্রয় নীতিমালায় মানসম্মত পণ্য কেনার বিধান থাকলেও তা মানছে না এনসিটিবি। তারা দরপত্রে কাগজের মিলগুলোর সিএম লাইসেন্স থাকার বাধ্যবাধকতা উল্লেখ করে না। এতে নিম্নমানের কাগজে ছাপা বই পৌঁছায় শিক্ষার্থীদের হাতে।

এনসিটিবির চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, সরকারি ক্রয় নীতিমালা অনুযায়ীই আমরা দরপত্র আহ্বান করা হয়। আর একই কাগজ ৩-৪ দফা পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। এতে আমাদের নিজস্ব লোক ছাড়া বাইরের কোম্পানিও মান যাচাই করে। ফলে মানহীন কাগজে বই ছাপার সুযোগ খুবই কম।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৫১ ঘণ্টা, মার্চ  ২৯, ২০১৭
জিপি/এইচএ

** এনসিটিবি’র মানহীন কাগজ কেনার পাঁয়তারা

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।