ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

শিক্ষার্থীদের বইয়ের জন্য এবারও মানহীন কাগজ!

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২১৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৮, ২০১৭
শিক্ষার্থীদের বইয়ের জন্য এবারও মানহীন কাগজ! বই ছাপানোর জন্য মানহীন কাগজ কেনার সব আয়োজন সম্পন্ন করেছে এনসিটিবি

ঢাকা: এবারও বই ছাপানোর জন্য  মানহীন কাগজ কেনার সব আয়োজন সম্পন্ন করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। তারা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) সনদবিহীন মিল থেকে কিনছে এসব কাগজ। এতে একদিকে যেমন শিক্ষার্থীদের হাতে নিম্নমানের বই যাবে, তেমনি সরকারও বঞ্চিত হবে বড় অঙ্কের রাজস্ব আয় থেকে।

সরকারি প্রতিষ্ঠানটির সূত্র মতে, আগামী ২০১৮ শিক্ষাবর্ষে চার কোটি ২১ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে বিনামূল্যে বই বিতরণ করার লক্ষ্য নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে প্রাথমিক (বাংলা ও ইংরেজি ভার্সন) স্তরের দুই কোটি এক লাখ ৬৮ হাজার ৩৬৬ শিক্ষার্থীর জন্য ৩৩টি বিষয়ের ১০ কোটি ২২ লাখ ২৭ হাজার ১১টি বই ছাপানো হবে।

মাধ্যমিক (বাংলা ও ইংরেজি ভার্সন) স্তরের এক কোটি ২৭ লাখ ৪৫ হাজার ৯৩ শিক্ষার্থীর জন্য ছাপানো হবে ১১৪ বিষয়ের ১৭ কোটি ৮৯ লাখ ২৩ হাজার ৭৩৩টি বই। আর ইবতেদায়ী ও দাখিলের ১২৪ বিষয়ে ৫৪ লাখ তিন হাজার ৪৬৯ শিক্ষার্থীর জন্য ছাপানো হবে পাঁচ কোটি ৭৮ লাখ ৫৮ হাজার ৮২৯টি বই।

এরই মধ্যে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রায় ১৮ কোটি বই ছাপার কাগজ কিনতে দরপত্র আহ্বান করেছে এনসিটিবি। এ বই ছাপানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের ২৩ হাজার ৭০০ টন কাগজ কেনা হবে। এর মধ্যে থাকবে ২১ হাজার ৫০০ টন হোয়াইট প্রিন্টিং পেপার এবং দুই হাজার ২০০ টন আর্ট কার্ড।  

সোমবার (২৭ মার্চ) দরপত্র জমা দেওয়ার সময়সীমা শেষ হয়েছে। মঙ্গলবার (২৮ মার্চ) এ দরপত্র উন্মুক্ত করা হবে।

অভিযোগ উঠেছে, এই বিপুলসংখ্যক বই ছাপানোর জন্য বিএসটিআইয়ের সনদবিহীন কাগজের মিল থেকেই কাগজ কিনতে উন্মুখ এনসিটিবি।  প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তারা বিএসটিআইয়ের সার্টিফিকেশন মার্কস (সিএম) সনদ নেই এমন পেপার মিলের কাছ থেকে কাগজ কেনার চেষ্টা করছে। এতে সংশ্লিষ্ট মিলগুলোর কাছ থেকে বড় অঙ্কের ‘কমিশন’ বাগানোর সুযোগ থাকবে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের। তাই দরপত্র আহ্বানের সময়ও বিএসটিআই সনদের বাধ্যবাধকতা রাখেননি এনসিটিবির কর্মকর্তারা।

অথচ বিএসটিআইয়ের মহাপরিচালক দরপত্রের মাধ্যমে কাগজ কেনার সময় এর গুণগত মান যাচাইসহ বিএসটিআইয়ের সিএম লাইসেন্স জমাদানের শর্ত আরোপের তাগিদ দিয়েছিলেন। অভিযোগ উঠেছে, মানহীন কাগজ উৎপাদনকারী মিলকে কাজ পাইয়ে দিতেই সিএম লাইসেন্সের বাধ্যবাধকতা রাখেননি এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।  

গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে বিএসটিআইয়ের সেসময়কার মহাপরিচালক ইকরামুল হক এনসিটিবির চেয়ারম্যানকে দেওয়া এক চিঠিতে বলেন, এনসিটিবির বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত কাগজ গুণগত মান অনুযায়ী হওয়া প্রয়োজন। দরপত্রের মাধ্যমে কাগজ কেনার সময় এর গুণগত মান যাচাইসহ বিএসটিআইয়ের সিএম লাইসেন্স জমাদানের শর্ত আরোপ করারও তাগিদ দেন তিনি চিঠিতে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ মুদ্রণশিল্প সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, পণ্যের মান যাচাইয়ের জন্যই বিএসটিআই নামে সরকারের একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এখন সেই বিএসটিআইয়ের সনদের মূল্য যদি এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ না দেয়, তাহলে কোনোভাবেই মানসম্মত বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব নয়।  

তিনি আরও বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠান এনসিটিবির এবারের দরপত্রে অংশগ্রহণ করছে তাদের দরপত্রের স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী কাগজ উৎপাদনেরই সক্ষমতা নেই। অথচ দেখা যাবে তারাই বেশি কাগজ সরবরাহের আদেশ পাচ্ছে। এর অর্থ পরিকল্পিতভাবেই নিম্নমানের কাগজ কেনা হচ্ছে। ’

লেখা ও ছাপার কাগজের জন্য বিএসটিআই থেকে সিএম লাইসেন্স গ্রহণে সরকারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বিএসটিআই অর্ডিন্যান্স ৩৭ (১৯৮৫) এবং বিএসটিআই (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট ২০০৩ অনুযায়ী, সিএম লাইসেন্স ছাড়া কাগজ-পণ্যের বিক্রয়, বিতরণ ও বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন প্রচার নিষিদ্ধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ বিধান অমান্যকারীদের কারাদণ্ড অথবা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। অথচ কিছু উৎপাদনকারী, আমদানিকারক অথবা বিক্রেতা এখনো বিএসটিআইয়ের সিএম লাইসেন্স না নিয়ে গুণগত মান যাচাই ছাড়াই অবৈধভাবে লেখা ও ছাপার কাগজ বিক্রি করে আসছে।  

অন্যদিকে, যেসব মিলের সিএম লাইসেন্স রয়েছে, তারা প্রতি টন কাগজ উৎপাদনের ক্ষেত্রেই সরকারকে রাজস্ব দেয়। অথচ সিএম লাইসেন্সবিহীন মিল এবং নকল লাইসেন্স নেওয়া বিভিন্ন মিল থেকেই এবার কাগজ কিনছে এনসিটিবি। এতে শিক্ষার্থীদের হাতে নিম্নমানের বই যেমন ‍যাচ্ছে, পাশাপাশি সরকারও হারাচ্ছে বড় অঙ্কের রাজস্ব।

এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএমএ) গত ২১ মার্চ শিল্পমন্ত্রী বরাবর পেশ করা এক আবেদনে বলেছে, এনসিটিবি আইনের তোয়াক্কা না করে বিএসটিআই মান ছাড়াই কাগজ ও মুদ্রিত বই ক্রয় করে চলছে। এতে একদিকে আইন অমান্য করা হচ্ছে; অন্যদিকে মুদ্রিত বইয়ের গুণগত মান বজায় থাকছে না।  

এ আবেদনের অনুলিপি পাঠানো হয়েছে অর্থমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, অর্থসচিব, শিক্ষাসচিব, শিল্পসচিব ও বিএসটিআইয়ের মহাপরিচালকের কাছেও।  

আবেদনে আরও বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীরা মানসম্মত বই না পাওয়ায় বই উৎসবের মতো সফল অর্জন যেমনি সঠিকভাবে মূল্যায়ন হচ্ছে না, তেমনি ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে সরকারের। বিএসটিআইয়ের অনুমোদনহীন মিলের কাছ থেকে কাগজ কেনায় সরকারও রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। টেন্ডার আহ্বানের ক্ষেত্রে বিএসটিআই সনদ বাধ্যতামূলক করতে বিপিএমএ একাধিকবার এনসিটিবির কাছে আবেদন জানালেও এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।  

শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট বিভাগকে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানান অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা।

এসব বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, দেশে এখন কাগজের মিল আছে প্রায় ৯০টি। কিন্তু বিএসটিআইয়ের সিএম লাইসেন্স আছে মাত্র ১৫টির। এখন যদি সিএম লাইসেন্স থাকা মিলগুলোর কাছ থেকে কাগজ কেনা হয়, তাহলে কোনো প্রতিযোগিতা থাকবে না। সিন্ডিকেট করে ওই ১৫টি মিল দাম বাড়াবে। তাই দরপত্রে বিএসটিআইয়ের অনুমোদনের কথা উল্লেখ করা হয় না। তবে আমরা পিপিআর অনুযায়ী টেন্ডার আহ্বান করি এবং স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী কাগজ বুঝে নিই। যদি বই ছাপানোর সময়ও কাগজের মানে গরমিল ধরা পড়ে, তাহলেও আমরা সেই কাগজ বাতিল করার ক্ষমতা রাখি।

বাংলাদেশ সময়: ০৮০৮ ঘণ্টা, মার্চ ২৮, ২০১৭
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad