ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

পূণ্যস্নানে দুই বাংলা প্রাণের মেলা

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫৭ ঘণ্টা, মার্চ ২৬, ২০১৭
পূণ্যস্নানে দুই বাংলা প্রাণের মেলা ভারতের দক্ষিণ ত্রিপুরার সাব্রুমে ফেনী নদীতে বারুনী স্নান ও মেলা, ডালিম হাজারী/বাংলানিউজ

ত্রিপুরা (সাব্রুম) থেকে: চৈত্রের মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথি। এপারে বাংলাদেশের খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় উপজেলা। ওপারে দক্ষিণ ত্রিপুরার সাব্রুম। বছরের এই একটি দিনের জন্য দুই পাড়ের মানুষের অপেক্ষা। উৎসবের আমেজে গুটিয়ে যায় দু’দেশের সীমারেখা।

নাড়ির টানে দুই পাড়ের মানুষ কাঁটাতারের সীমারেখা একদিনের জন্য ছিন্ন করে মিলিত হয়।

রোববার (২৬ মার্চ) ভারতের দক্ষিণ ত্রিপুরার সাব্রুমের বারুনী মেলায় গিয়ে দেখা যায় এমন চিত্র।

ভারত-বাংলাদেশের মানুষের অংশগ্রহণে উৎসব মুখর হয়ে ওঠে গোটা সাব্রুম। এ যেন দুই বাংলার মেলবন্ধন। ঐতিহ্যবাহী বারুনী স্নানোৎসবকে ঘিরে রামগড়-সাব্রুম সীমান্তে ফেনী নদীতে সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি মুখরিত হয়ে উঠে লাখো পূণ্যার্থী ও দর্শনার্থীর সমাগমে।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বৃটিশ আমল থেকেই চৈত্রের মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে প্রতিবছর ফেনী নদীতে বারুনী মেলায় মিলিত হন দুই বাংলার লাখো হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তারা পূর্ব পুরুষদের আত্মার শান্তির জন্য তর্পন করেন এখানে।

রামগড় ও সাব্রুম অংশে নদীর দুই তীরে দুই দেশের পুরোহিতরা সকালেই বসেন পূজা অর্চনার জন্য। পূর্ব পুরুষদের আত্মার শান্তি কামনা ছাড়াও নিজের পূণ্যলাভ ও সব রকম পাপ, পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হওয়ার উদ্দেশে ফেনী নদীর বারুনী স্নানে ছুটে আসেন সনাতন ধর্মাবলম্বী আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা।

ভারতের দক্ষিন ত্রিপুরার সাব্রুমে ফেনী নদীতে বারুনী স্নান ও মেলা, ডালিম হাজারী/বাংলানিউজবাংলাদেশ পার্বত্যাঞ্চল খাগড়াছড়ি আর ত্রিপুরার মধ্যখানে রয়েছে ছোট্ট নদী “ফেনী”। ছোট্ট এই নদীটি ভাগ করে রেখেছে দুই দেশকে। এপারে বাংলাদেশের রামগড় উপজেলা আর ওপারে ত্রিপুরার সাব্রুম অঞ্চল। নদী পার হয়ে মাত্র কয়েকশ’ গজ হাঁটলে সাব্রুম বাজার। যেখানে প্রতিবছর হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসব বারুনী স্ন্যান উপলক্ষে বসে বারুনী মেলা। সকাল ৭টা থেকেই শুরু হয় এই স্নানোৎসব।

যা উভয় দেশের মানুষের কাছে খুবই জনপ্রিয়। স্নান বা পূজা আর্চনা ছাড়াও দুই দেশে বসবাসরত আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে অনেকে ছুটে আসেন দূর-দূরান্ত থেকে। বহুকাল থেকেই এদিনে দু’দেশের সীমান্ত অঘোষিতভাবে কিছু সময়ের জন্য উন্মুক্ত থাকার সুবাদে এপার বাংলার মানুষ ছুটে যায় ওপারের সাব্রুম মহকুমা শহরে, আবার ওপার বাংলার লোক চুটে আসেন রামগড়ে। এ মেলাকে ঘিরে দু’দেশের মানুষের মধ্যে তৈরি হয় ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতির মেলবন্ধন।

বারুণী মেলায় শুধু বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ নয়, ত্রিপুরা, মারমা, চাকমা, মুসলিম সব সম্প্রদায়ের মানুষের সমাগম ঘটে এখানে। এটি ধর্মীয় উৎসব হলেও দু’দেশের বিভিন্ন জাতি, সম্প্রদায় ও ধর্মের মানুষের সমাগমে সার্বজনীন আনন্দ মেলার ঐতিহ্যে পরিণত হয়।

সরেজমিন দেখা যায়, রামগড় বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ফেনী নদী পার হয়ে হাজার হাজার বাংলাদেশি এ মেলায় অংশগ্রহণ করছে। নদীর মাঝখানে শতাধিক সাধকের মন্ত্র নিয়ে স্নান করছে হিন্দু ধর্মালম্বীরা।

ভারতের দক্ষিন ত্রিপুরার সাব্রুমে ফেনী নদীতে বারুনী স্নান ও মেলা, ডালিম হাজারী/বাংলানিউজবছরের তুলনায় এবার সীমান্ত অতিক্রম করা অনেকটাই সহজ ছিল। কারণ এ বছর বৃষ্টি না হওয়ায় নদীর পানি কম ছিল। নদী পার হয়ে মাত্র কয়েকশ’ গজ হাঁটলেই দেখা মিলে সাব্রুম বাজার। প্রথমেই ঘুরে দেখলাম পুরো বাজারটি। বাজারের প্রতিটি দোকানেই ছিল ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড়। মূল মার্কেটে যেতে হয় সাব্রুম থানার সামনে দিয়ে। এখানে বসানো হয়েছে পুলিশ চেকপোস্ট।

মেলায় ঘুরতে আসা ভারতীয় দর্শনার্থী রিতা পাল জানান, বারুনী মেলায় বাংলাদেশ থেকে অনেক মানুষ আসে, আমরাও তাদের দেশে যাই। সারাদিন কেনাকাটা, আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ আর আনন্দ-উল্লাস শেষে বিকেলে নিজ দেশে ফেরার পালা।

একইভাবে রামগড় থেকেও ওপারে যান অগণিত মানুষ। ভারতীয়রা রামগড় বাজার থেকে সেমাই, নারিকেল, সাবান, শুটকি মাছ ইত্যাদি কিনে নিয়ে যায়। আবার ওপারের সাব্রুমের থেকেও এপারের লোকজন বিভিন্ন জিনিসপত্র কিনে আনে।

ঐতিহ্যবাহী এ বারুনী মেলা সম্পর্কে রামগড়ের অধিবাসী জেলা শিক্ষা অফিসার রামেশ্ব শীল বলেন, ভারত বিভক্তির আগে এখানে বারুনী মেলায় বাংলাদেশ ভারত দু’দেশের দূর-দূরান্তের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিপুল পূণ্যার্থীর সমাগম হত। পাকিস্তান আমলেও ফেনী নদীতে বারুণী মেলা বসতো। অবশ্য তখন দু’দেশের সীমান্ত পারাপারের সুযোগ ছিল না। দেশ স্বাধীনের পর থেকেই এ মেলাকে ঘিরে সীমান্ত আইনের অঘোষিত শিথিলতার কারণে দু’দেশের মানুষ একে অপরের সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। এ মেলাটি এখন দু’দেশের সংস্কৃতির অংশ হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ২১৫২ ঘণ্টা, ২৬ মার্চ, ২০১৭
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।