ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

পিলখানা, রাজারবাগ, ঢাবি-র গণহত্যার স্মৃতিচারণ

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫০ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৭
 পিলখানা, রাজারবাগ, ঢাবি-র গণহত্যার স্মৃতিচারণ আলোকচিত্র প্রদর্শনী। ছবি- কাশেম হারুন

ঢাকা: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন, তৎকালীন ইপিআর সদর দফতর (পিলখানা), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) এবং পুরান ঢাকা শাঁখারীবাজারে হানাদার পাকবাহিনী নৃশংস নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল। চালানো হয়েছিল ঘুমন্ত মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি। পুলিশ লাইন, রাজারবাগ আর ঢাবিতে চালানো হয়েছিল পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যাপক আক্রমণ।

শনিবার (২৫ মার্চ) সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা-জাদুঘর প্রাঙ্গণে আয়োজিত এক আলোচনা সভা ও আলোকচিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠানে সেইসব ঘটনার বর্ণনাই দিলেন সংশ্লিষ্টরা। এতে উপস্থিতিদের মানসপটে যে ভয়াবহ আর নির্মম চিত্র ফুটে ওঠে তাতে পুরো প্রাঙ্গণের বাতাস তখন হয়ে ওঠে ভারী।


ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলছিলেন, ২৫ মার্চ কি হয়েছিলো। সেদিন বিকাল থেকেই রাজারবাগ ও আশেপাশের এলাকায় বিদ্যুতের সকল লাইন অফ করে দেওয়া হয়েছিল। এক ঘণ্টা, দুই ঘণ্টা, তিন ঘণ্টা অতিবাহিত হয় কিন্তু বিদ্যুত আর আসে না। পুলিশ সদস্যরা কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে বলে আঁচ করতে পারেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর পরিস্থিতি এমনিতেই অবনতির দিকে যাচ্ছিল। পুলিশ বাহিনিও প্রস্তুতি নিচ্ছিল স্বাধীনতাযুদ্ধের। তৎকালীন ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ-এর দেহরক্ষী আব্দুল আলীও ওইদিন ছিলেন পুলিশ লাইনেই।

তাঁর দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী, পরিস্থিতি যখন থমথম করছিল তখন পুলিশ লাইনের পূর্ব-দক্ষিণ কোনায় পুকুরপাড়ে সবাই মিলে বৈঠক করেন। কি হতে পারে তাই নিয়ে চলছিল আলোচনা। রাত ১০টা কি সাড়ে ১০টার দিকে হঠাৎ একটি মোটরসাইকেল উত্তর গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে বৈঠকরত পুলিশদের বলেন,আপনারা প্রস্তুতি নেন। ফকিরাপুলে আর্মির ৬০-৭০টা ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরেই হামলা হবে। এই মোটর সাইকেল আরোহী ঠিক কে ছিলেন, তা জানা না গেলেও তিনি বঙ্গবন্ধুর সন্তান ছিলেন। আব্দুল আলী সে সময় পাগলাঘণ্টা বাজিয়ে দেন। সব পুলিশ সদস্য একত্র হয়ে কুৎ (অস্ত্রাগার) এর চাবির জন্য আরআইকে খুঁজতে থাকেন। তাকে না পেয়ে অস্ত্রাগারের তালা গুলি করে ভেঙ্গে যে যার মত অস্ত্র-গোলা বারুদ নিয়ে নেন।

২০-২৫ জন করে এক একটি দলে ভাগ হয়ে তারা পুলিশ লাইনের বিভিন্ন ব্যারাক ও আশেপাশের এলাকায় অপেক্ষা করতে থাকেন। রাত ১২টার দিকে ভারী অস্ত্র থেকে মুহুর্মুহু গোলা ছুঁড়তে থাকে পাক আর্মি। পাল্টা জবাব দেন পুলিশরা। এভাবে চলার এক পর্যায়ে তারা ক্যান্টনমেন্টে খবর দেয়---যতটা সহজ মনে করেছিলাম ততটা সহজ নয়। আর্টিলারি (গোলন্দাজ) পাঠান। আনুমানিক ভোর ৫টা দিকে লাইটিং এর মাধ্যমে দেখে দেখে পুলিশ সদস্যদের অবস্থানের ওপর আর্টিলারি আক্রমণ করা হয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় সব নথিপত্র।

এ অবস্থায় অনেকেই আশেপাশের এলাকা দিয়ে পালিয়ে জীবন বাঁচান। ২ হাজার ৫শ পুলিশ সদস্যের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। ১২ জনের লাশ পাওয়া গেছে। এমন অবস্থাও দেখা গেছে, ফজরের নামাজপড়া অবস্থায় অনেককে মারা হয়েছে। ভাতের থালার ওপর রক্তাক্ত লাশ পাওয়া গেছে। এভাবেই তারা হত্যা করেছে। পুলিশই প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। ত্যাগ স্বীকার করেছিল।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা-জাদুঘর প্রাঙ্গণে আয়োজিত এক আলোচনা সভা ও আলোকচিত্র প্রদর্শনী।  ছবি- কাশেম হারুন
বর্তমান বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-এর অতিরিক্ত মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আনিসুর রহমান পিলখানার বাঙ্গালি ইপিআর সদস্যদের ওপর অত্যাচারের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ইপিআর এর বাঙ্গালি জোয়ানরা সত্তর-এর নির্বাচন থেকেই আওয়ামী লীগকে সহায়তা করেছে। ২৩ মার্চ বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল। এরপর থেকে বাঙ্গালি জোয়ানদের হাতে হয় অস্ত্র দেওয়া হতো না। অস্ত্র দিলেও গোলা দেওয়া হতো না। এই অবস্থায় ২৫ মার্চ দুপুরে হঠাৎ পিটি শুরু হয়। এতে সন্দেহের সৃষ্টি হয় জোয়ানদের মধ্যে। কেননা, দুপুরে কখনো পিটি হয় না। সেদিন মোট ২ হাজার ৫শ ইপআর সদস্যের মধ্যে বাঙ্গালি ছিল ১ হাজার ১শ।

সন্ধ্যার আগে থেকেই বিরাজ করছিল থমথমে পরিস্থতি। রাতে হঠাৎ করেই শুরু হয় আক্রমণ। এতে শহীদ হন ৮১৭ জন জোয়ান। অনেকেই পালিয়ে জিঞ্জিরা চলে যান। সেখানে সংগঠিত হয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। জোয়ানদের অনেককেই মোহাম্মদপুরের একটি স্কুলে ধরে নিয়ে গিয়ে ২৬, ২৭ ও ২৮ মার্চ নির্মম নির্যাতন করা হয়।
ঢাবির উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক
ঢাবির উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, পাকসেনারা ২৫ মার্চ হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছিল ঢাবির বিভিন্ন ছাত্রাবাসে। কেননা, তাদের হাতেই ছিল নেতৃত্ব। আবার ১৪ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের ঠিক আগ মুহূর্তে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের, শিক্ষকদের ধরে নিয়ে হত্যা করেছে। এই ক্ষতি পূরণ হবার নয়।

তিনি বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন গণহত্যা আর হয়নি। এটা নজিরবিহীন ঘটনা। অনেক গণহত্যায় এর চেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে। কিন্তু নয় মাসে কোনো গণহত্যায় ৩০ লাখ মানুষ মারা হয়নি। তাই ২৫ মার্চ গণহত্যা আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হওয়ার দাবি রাখে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা-জাদুঘর প্রাঙ্গণে আয়োজিত এক আলোচনা সভা ও আলোকচিত্র প্রদর্শনী।  ছবি- কাশেম হারুন
‘রক্তাক্ত ২৫ মার্চ, গণহত্যার ইতিবৃত্ত’ শীর্ষক অনুষ্ঠানটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজন করে। এতে মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মাহমুদ রেজা খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ক্যাপ্টেন অব. এ বি এম তাজুল ইসলাম, সংসদ সদস্য শাহজাহান কামাল ও  একে আব্দুল মোমিন প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই জাতীয়সঙ্গীত ও গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। অনুষ্ঠান শেষে আয়োজন করা হয় মুক্তিযুদ্ধের ওপর আলোকচিত্র প্রদর্শনী। মন্ত্রী আলোকচিত্রগুলো ঘুরে ঘুরে দেখেন। এছাড়া এতে প্রদর্শিত হয় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক চলচ্চিত্রও। মন্ত্রী জাদুঘরে একটি চলচ্চিত্রের প্রদর্শনীতেও উপস্থিত হন। ২৬ মার্চ পর্যন্ত এ আয়োজন চলবে।

বাংলাদেশ সময়: ২২৩১ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৭
ইইউডি/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad