ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

‘শাশুড়ি বললেন, বেশিক্ষণ বাঁচবে না আমার ছেলে’

মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪১ ঘণ্টা, মার্চ ২৪, ২০১৭
‘শাশুড়ি বললেন, বেশিক্ষণ বাঁচবে না আমার ছেলে’ ইতিহাসের নির্মম হত্যাকাণ্ডে স্বামী হারানোর স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন রাজকুমারী রায়

ঢাকা: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ভয়াল রাত। অপারেশন সার্চলাইটের মধ্য দিয়ে ঢাকার বুকে এক পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডে মেতে ওঠে পাকিস্তানি হানাদারেরা। রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকে শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পিলখানায় তৎকালীন ইপিআর-এর ব্যারাকে হামলা চালায় হানাদার বাহিনী।

২৫ মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে এক নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে লাশের স্তূপ তৈরি করে পাকবাহিনী। মায়ের সামনে সন্তান, স্ত্রীর সামনে স্বামী আর সন্তানের সামনে বাবাকে হত্যা করে তারা।

যাদের দিয়ে লাশ টেনে গর্তে ফেলানো হয়, তাদেরকেও গুলি করে সেই লাশের স্তূপেই ফেলা হয়। ইতিহাসের এই নির্মম হত্যাকাণ্ডে স্বামী হারানোর স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন রাজকুমারী রায়। সেই দুঃসহ রাতের কথা বাংলানিউজের কাছে তুলে ধরেন তিনি।

মধুর ক্যান্টিনের কাছে নিপা ভবনে চাকরি করতেন রাজকুমারীর স্বামী মনভরণ রায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজকুমারীর বয়স আনুমানিক ২৫। দুই ছেলে আর এক মেয়ের মা তখন এই তরুণী। বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখেছেন নির্মমভাবে স্বামী হত্যার দৃশ্য। মেয়েকে আঁচলের নিচে রেখে, দুই ছেলেকে শক্ত করে ধরে রেখেছিলেন। স্বামী বিয়োগের ঘটনার বর্ণনা দিতে যেয়ে এখন আর গলা খুব ভারী হয়ে আসে না রাজকুমারীর। বরং একখানি স্থায়ী ঘরের জন্যে কণ্ঠে তার হাহাকার!

সেই রাতের বর্ণনা দিয়ে রাজকুমারী বলেন, ২৫ মার্চ রাত ১১টার দিকে ঘুমাতে গিয়েছিলেন। তবে কয়েকজন ছাত্র এসে সতর্ক করে। তবে সেই ছাত্ররা হয়তো যেয়ে পৌঁছাতেও পারেনি। হয়তো তাদেরকেও মেরে ফেলেছে। এরমধ্যেই বোমার আওয়াজে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে জগন্নাথ হল। জগন্নাথ হলের মাটিও যেন কেঁপে উঠছিল। হানাদারেরা চারদিক থেকে ট্যাংক নিয়ে হল ঘিরে ফেলে।
রাজকুমারী রায়
রাজকুমারী বলেন, ‘ঘণ্টাব্যপী জগন্নাথ হলে হত্যাযজ্ঞ চালায় হানাদারেরা। এরপর রাত আড়াইটার দিকে ঘরে আসে ৮ থেকে ১০ জন পাক সেনা। এসে দরজায় লাথি মারে। বলতে থাকে, দরজা খোল, নাইলে ভেঙে ফেলবো। ভাইঙা যদি ঢুকি তবে সরাসরি গুলি করবো। আমার শাশুড়ি কৌশল্যা ঘাবড়ে যেয়ে দরজা খুলে দেন। আমার কাকি শাশুড়িও ঘরে ছিলেন। স্বামী আলমারির ভেতরে লুকিয়ে পড়েন। বলেন, সন্তানদের যেন হাতছাড়া না করি। ’

‘ভোরের দিকে আমাদের বলেন, তোমরা ঘর থেকে বের হও। অনেক মেয়ে লোক ছিল বাইরে। ততক্ষণে প্রায় সকল পুরুষকেই মেরে ফেলেছে। ’

এক সময় বের হয়ে আসতে হয় মনভরণকেও। রাজকুমারী বলেন, ‘এর মধ্যে ওরা বলে ঘরে আগুন দেবে। তখন আমার স্বামীও বের হয়ে আসে আলমারি থেকে। ওকে ধরে নিয়ে যায়। আমার শাশুড়ি জিজ্ঞাসা করে, ওকে কোথায় নিয়ে যান! ওরা বলে, কাজ করাতে নেই। শাশুড়ি বলে কী কাজ? ওরা তখন রেগে যায়। ’

মনভরণসহ আরো কয়েকজনকে নিয়ে লাশ বহন করা হয়। বৃদ্ধা বলেন, ‘ওদের ১৫ বা ২০ জনকে দিয়ে লাশ টুকাতে নিয়ে যায়। অনেক লাশ। লাশ নিয়ে মাঠের উত্তর পশ্চিম কোণে জড়ো করা হয়। এরপর যারা লাশ টোকাচ্ছিল, তাদের সেখানে লাইন ধরে দাঁড় করানো হয়। আমরা তখন বুঝতে পারি। আমরা একটা ভাঙা ঘরের ছিদ্র দিয়ে দেখতে থাকি। ’

একটু ভরাট হয়ে আসে রাজকুমারীর গলা, ‘তখন সকাল সাড়ে নয়টা বা দশটা। ওরা লাইন ধরতে চাচ্ছিল না। খুব মাফ চাইছিল, ছেড়ে দিতে বলে। ওরা লাইন ধরায় জোর করে। আমার ছেলে মেয়েও দেখছিল। ১২ বছরের বিন্দু আর ৫ বছরের বিমল পাশে। মেয়ে উষা ছিল কোলের বাচ্চা। ও খালি আমাকে বলতো, জলদি কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখো। কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখো। মাইরা ফেলবো। যারা লাশ টোকায় সবাইরে মেরে ফেলে। শুধু ছোট মোহন বেঁচে গিয়েছিল। সে তখন ইউনিভার্সিটির ছাত্র। জগন্নাথ হলে ঘর বানিয়ে থাকতো। ’

হত্যাযজ্ঞ শেষে হল ছাড়তে শুরু করে হানাদারেরা। রাজকুমারীর ভাষ্যে, ‘তারপর ধীরে ধীরে ওরা চলে যেতে থাকে। ট্যাংকগুলো ঘুরতে শুরু করে। লাশের ওখান থেকে অর্ধমৃতরা জল জল বলছিল। তখন আমার শাশুড়ি ও কাকি শাশুড়ি সেখানে যেয়ে হাজির হয়। অনেকেই যায় তখন। ’
রাজকুমারী রায়
মরভরণ রায় তখনও বেঁচে ছিলেন, তবে অন্তিম মুহূর্তে গোঙাচ্ছিলেন। রাজকুমারী বলেন, ‘উনি শাশুড়িকে বলতে থাকেন, মা আমি জল খাবো। আগে একটু বাচ্চা আনেন। ওর মাকেও নিয়ে আসেন। শাশুড়ি এসে আমাকে বলেন, চলো। বাচ্চাও নাও। আমার ছেলে বাঁচবে না। ’

সন্তানদের নিয়ে চিন্তা হয় রাজকুমারীর, ‘আমি বলি, ওখানে যাওয়া ঠিক হবে না। কোনোখান থেকে গুলি করে দিলেতো বাচ্চাগুলাও যাবে। সারা রাত বাঁচাইয়া রাইখা এখন বাচ্চাগুলারে নিয়ে ওখানে যাবো! আর মেয়েটাও ছাড়ে না। খালি কামড়াইয়া ধরে। শাশুড়িকেই স্বামীকে নিয়ে আসতে বলি। ’

‘শাশুড়ি আর কাকি শাশুড়ি কয়েকজন নিয়ে যেয়ে উনাকে নিয়ে আসেন। আমি যেয়ে অর্ধেক পথে ধরি। আমার কাপড়ও রক্তাক্ত হয়ে যায়। আমি জানতে চাই, এতো রক্ত কই থেকে আসে। তিনি বলেন, আমাকে পেছন ফিরিয়ে দেখো। সেখানে কিছু নাই। অনেক গুলি। ’

রাজকুমারী তার স্বামীকে ঘরে এনে বালিশে মাথা রাখেন। ‘জল খাওয়ালাম। খাওয়ার পর আস্তে আস্তে দুই চোখ বন্ধ হয়ে আসলো। ’

তবে স্বামীর লাশ নিজের কাছে রাখতে পারলেন না। দাহও হলো। তিনি বলেন, ‘ওখানে যারা ছিলো তারা লাশ রেখে আসতে বলে। এখানে এসে লাশ দেখলে আর কাউরে বাঁচাইয়া রাখবে না হানাদারেরা। সেদিন দাহ দূরের কথা! শরীর কাঁপছিল সারাক্ষণ। পরে যেখানে সব লাশ রাখা সেখানে রেখে আসলাম। যেখানে শোয়া ছিলেন, সেখানে শুইয়ে দিয়ে আসলাম। ’
রাজকুমারী রায়
স্মৃতির পৃষ্ঠা আওড়ান রাজকুমারী। এরপরের সময়গুলো পালিয়ে বেড়ানো। বলেন, ওদুদ মিয়া ও শিবলির বইয়ের দোকান ছিল মসজিদের ওখানে। শিবলি কাঁদতে কাঁদতে হলে আসে। তার পরিবার নিয়ে যাওয়ার সময় আমাদেরও যেতে বলে। তাদের সঙ্গে তিন সন্তানকে নিয়ে বের হয়ে যান রাজকুমারী।

২৬ মার্চ হোসনি দালানে ছিলেন এক রাত। বাংলানিউজকে বলেন, ‘সেখান থেকে বের হয়ে এসে আবার ভাবি জগন্নাথ হলে যাবো। তখন এইখানে কলেজের এখানে জলের ট্যাংকি ছিল। সেখানে ভাসুরেরা তিন-চারজন ছিলেন। তারা বলেন, আবারো জগন্নাথ হলে! ওরা কি ছাড়বো। ’

মেডিকেলের লাশ ঘরের পেছনে চলে যায় পরিবারটি। আরেকটা লাশের ঘরে জায়গা হয়। সেখানে বসিয়ে রেখে ভাসুরও বলেন, ‘চুপ করে বসে থাকো। পোলাপাইন কান্দাইয়ো না। ’

মুক্তিযুদ্ধের বাকি সময়টুকু শুধুই পালিয়ে বেড়ানোর। বলেন, ‘নয় মাস শুধু দৌড়ের ওপর ছিলাম। গ্রাম থেকে শহরে, শহর থেকে গ্রামে। আবারো পুরনো ঢাকায় ফিরে সুইপার কলোনিতে আসি। এটা নয়াবাজারের আগে। ’

সন্তানদের প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করতে রাজকুমারী বলেন, যুদ্ধ শেষ হলে মিত্রবাহিনীর এক সেনা আমার একটি সন্তান চেয়েছিলেন। অনেকেই বলেছিলেন, তোমারতো ২টা ছেলে, একজনকে দেও। আমি দেইনি। নিজে গাভী পেলেছি, দুধ বিক্রি করে সংসার চালিয়েছি। এই সন্তানদের বড় করেছি। ’

বাংলাদেশ সময়: ২১৩০ ঘণ্টা, মার্চ ২৪, ২০১৭
এমএন/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।