ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

ঐতিহ্যের শহীদমিনার সেজেছে আলপনায়, অন্য স্কুল গড়েছে এবারই নতুন

মুশফিক সৌরভ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৭
ঐতিহ্যের শহীদমিনার সেজেছে আলপনায়, অন্য স্কুল গড়েছে এবারই নতুন ঐতিহ্যের শহীদমিনার সেজেছে আলপনায়, অন্য স্কুল গড়েছে এবারই নতুন

বরিশালের শায়েস্তাবাদ ঘুরে এসে: বরিশাল শহরের উত্তরে ফুলতলা নদীর ওপারের ইউনিয়ন শায়েস্তাবাদের রামকাঠী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এবারের একুশে আয়োজন অন্যরকম। এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিজেরা ২৫ টাকা করে চাঁদা দিয়ে একটি ইটের অস্থায়ী শহীদ মিনার গড়েছে। তাই ওদের উত্তেজনাটা একটু বেশিই।

প্রতিবছরই তারা প্রভাতফেরি করে, শহীদ মিনারে ফুল দেয়। কিন্তু তা হতো কলাগাছ দিয়ে তৈরি শহীদ মিনারে।

এবার তাদের ইটের তৈরি অস্থায়ী শহীদ মিনার।

সোমবার (২০ ফেব্রুয়ারি) রামকাঠী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে সেই শহীদ মিনার নিয়েই ব্যস্ত দেখা গেলো শিক্ষার্থীদের। সকলের চোখেমুখে খুশির ভাব।  

নবম শ্রেণির ছাত্র সাগর বললো, ‘প্রতিবছর আমরা কলাগাছ দিয়ে শহীদ মিনার বানাতাম, এবার সবাই ২৫ টাকা করে দিয়ে একটি অস্থায়ী শহীদ মিনার বানাচ্ছি।  

১০ম শ্রেণির ইলিয়াস বললো, যখন কলাগাছ দিয়ে শহীদ মিনার বানিয়ে একুশে পালন করতাম তখন খুব কষ্ট হতো… এবার ভালো লাগছে।  

ছাত্র-ছাত্রীরা অস্থায়ী শহীদ মিনারে সাদা রং লাগাচ্ছিলো।  আম গাছ থেকে ডাল পেড়ে তাতে শোলায় কাটা বাংলা বর্ণ ঝুলিয়ে দেয়ারও প্রস্তুতি চলছে।

শায়েস্তাবাদের রামকাঠী বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিজেরা চাঁদা তুলে ইটের শহীদ মিনার গড়েছেমঙ্গলবার (২১ ফেব্রুয়ারি) এই স্কুলে একুশের আয়োজনের মধ্যে রয়েছে সকালে প্রভাতফেরি। পরে স্কুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা ও দোআ মোনাজাত। সেসব আয়োজনে অংশ নেওয়ারও প্রস্তুতি চলছে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে।  

শায়েস্তাবাদের ঐতিহ্যবাহী স্কুল মোয়াজ্জেম হোসেন উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়েও দেখা গেলো শিক্ষার্থী-শিক্ষকরা একুশের আয়োজনে ব্যস্ত। ১৯৩৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুলে শহীদমিনারটিও ঐতিহ্যবাহী। যা নির্মিত হয় ১৯৬৯ সালে।  
সোমবার সকালে স্কুলে ঢুকেই দেখা গেলো শিক্ষকদের তত্বাবধানে শিক্ষার্থীদের পিটি-প্যারেড (কুচকাওয়াজ) চলছে। পিটি শেষে অনেকেই ক্লাশরুমে ফিরে গেলেও কয়েকজনকে শিক্ষার্থীকে দেখা গেলো স্কুলের একাডেমিক ভবনের সামনে শহীদ মিনারে দিকে এগিয়ে গেলো। পরে শহীদমিনার সংলগ্ন পুকুর পাড়ে বসে তাদের সঙ্গে কথা হয়। বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থী ফারিয়া ইসলাম ততক্ষণে কাজে লেগে পড়েছে। শহীদ মিনারের ওপর গাছ থেকে পড়া পাতা ও ধুলো-ময়লা ঝাড় দিয়ে পরিষ্কার করছিল সে।  

এগিয়ে গিয়ে কথা পাড়তেই জানা গেলো রোববার তারা শহীদ মিনারের বেদীতে আলপনা এঁকেছে। এখন যাতে ধুলো ময়লা না জমে, গাছ থেকে ঝরাপাতা পড়ে না থাকে সে জন্য ন্যস্ত আছে।

নবম শ্রেণির ছাত্রী তাহেরা খাতুন বললো, এই শহীদ মিনারকে ২১ শে ফেব্রুয়ারিতেই শুধু নয়, সারা বছরই তারা শ্রদ্ধার সাথে দেখে। কোনওদিনই যাতে কেউ শহীদ মিনারের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখাতে না পারে সেটা নিশ্চিত করে।
তাহেরা বললো, ভাষা শহীদদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাভাষার ইতিহাসের সাক্ষী শহীদ মিনার। এর প্রতি কখনোই অশ্রদ্ধা চলে না।  

বরিশালের শায়েস্তাবাদের এই স্কুলে শহীদমিনার গড়া হয়েছে ১৯৬৯ সালে

২১ শে ফেব্রুয়ারি সকালে প্রভাতফেরি শেষে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।  
 
আরেক শিক্ষার্থী জেরিন জানালো, তাদের বিদ্যালয় থেকে প্রতি বছরই ভোরে প্রভাতফেরি বের হয়। “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি- আমি কি ভূলিতে পারি ” এই গানের সুরে সুরে প্রভাতফেরি সদর ইউনিয়নের কয়েক কিলোমিটার পথ ঘুরে আবার বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসেই শেষ হয়। যে আয়োজন এবারেও থাকছে।

এই স্কুলের প্রভাতফেরির সাথে আশপাশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোও যোগ দেয়। প্রভাতফেরির পর শ্রেণি ও বিভাগ ভেদে শহীদমিনারে জানানো হয় ফুলেল শ্রদ্ধা। সেসব ফুলের মালা প্রতিটি শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নিজেরাই তৈরি করে।  

শুধু তাই নয় ভাষা দিবসকে কেন্দ্র করে দেশাত্মবোধক গান, আবৃতি ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতারও আয়োজন রয়েছে এই স্কুলে। সেজন্য শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতি চলছে সপ্তাহ দুয়েক ধরেই।

স্কুলের ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থী মোঃ মেহেদী হাসান বললো, শিক্ষকদের অনুপ্রেরণায় আমরা মহান একুশের চেতনাকে ধারণ করি। শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই বাংলাভাষা আমাদের অহঙ্কার।

একুশের সকালে খালি-পায়ে প্রভাতফেরিতে অংশ নেওয়া ভাষা দিবসে বাংলা কবিতা, গান গেয়ে পুরষ্কার পাওয়া এসব নিয়ে দিনটি বেশ আনন্দে কাটে শিক্ষার্থীদের।  

কোনও কোনও শিক্ষার্থী জানালো, কেবল যে স্কুলেই তা নয়, নিজেদের বাড়িতেও মাটি দিয়ে শহীদ মিনার বানিয়েছে তারা। সেখানেও ফুল দেয়া হবে।

স্কুলের প্রধান শিক্ষক সুলতান মাহমুদ জানালেন, ঐতিহ্যবাহী এই বিদ্যালয়ে ১৯৬৯ সালে তৈরি হয় শহীদ মিনার।
  
তিনি বললেন, ভাষা আন্দোলনের চেতনা আজও দেশে পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত নয়। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে, ধর্ম যার যার হলেও সংস্কৃতি সবার এটা মনে রেখেই বলতে হবে আমি বাঙালি।

শায়েস্তাবাদ স্কুল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলছেন প্রতিবেদক

স্কুলের প্রতিটি শিক্ষার্থীকে সে চেতনায় গড়ে তুলতে চান এই শিক্ষক। তিনি বলেন, আমরা চাই সামাজিক মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় থেকে বের হয়ে এসে শিক্ষার্থীদের মনে ধরিয়ে দিতে, কি এই একুশ, কি এই বাংলাভাষা, কি এই স্বাধীনতা।

একসময় এই বিদ্যালয়েরই ছাত্র ছিলেন সুলতান মাহমুদ। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, “এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে নয়, ছাত্র হিসেবে বলছি এখানে শহুরে পদ্ধতিতে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে নয়, চেতনায় উদ্ভুদ্ধ হয়ে প্রতিবছর আমরা প্রভাতফেরি করি, শহীদ মিনারে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। ”

৫২ এর ভাষা আন্দোলন নিয়ে আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, পুরষ্কার বিতরণী থাকবে। শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনায় দোআ মোনাজাত ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণও চলবে, জানালেন প্রধানশিক্ষক।  

বাংলাদেশ সময় : ১৭২০ ঘন্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৭
এমএস/এমএমকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।