ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

শ্রীমঙ্গলে লোক ঠকিয়ে বিত্তশালী ন্যাজ্যারিন মিশন

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন, ডিভিশনাল সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৩৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৭
শ্রীমঙ্গলে লোক ঠকিয়ে বিত্তশালী ন্যাজ্যারিন মিশন শ্রীমঙ্গলে লোক ঠকিয়ে বিত্তশালী ন্যাজ্যারিন মিশন

শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার): বছর তিনেক আগের কথা। শ্রীমঙ্গলের ন্যাজারিন মিশনে তখন নির্মাণ কাজ চলছিলো। সেখানে কাজ করতেন আরতি কর। একদিন প্রতিষ্ঠানটির নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত ইট-বালুর ট্রাকে চাপা পড়ে মারা যান তিনি। সেসময় তার একমাত্র মেয়ে নিশিতার বয়স ৩ বছর। বোনের মৃত্যুর পর সেখানে চাকরি নেন জত্না রানী কর। তাকে আশ্বাস দেওয়া হয় ক্ষতিপূরণ ও মেয়ের ভরণপোষণ বাবদ এককালীন টাকা দেওয়ার।

কিন্তু ভরণপোষণ কিংবা ক্ষতিপূরণ না দিয়ে উল্টো জত্নার উপর শারীরিক নির্যাতন শুরু করে। শ্লীলতাহানিরও অভিযোগ তোলেন জত্না।

এভাবে অভাব, দারিদ্র্যকে বোকা বানিয়ে ‘সেবা’ আর ‘কল্যাণ’- শব্দ দু’টি ব্যবহার করে সংঘবদ্ধভাবে লুটপাট, প্রতারণা করে চলেছে কানাডাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ন্যাজারিন মিশন।

শ্রীমঙ্গলে লোক ঠকিয়ে বিত্তশালী ন্যাজ্যারিন মিশন

২০১২ সালে শ্রীমঙ্গলের অসহায় চা শ্রমিকদের প্রলোভনে ভুলিয়ে কার্যক্রম শুরু করে ন্যাজারিন।   ধর্মভিত্তিক এ প্রতিষ্ঠানটি তাদের কর্মী ও স্থানীয়দের সঙ্গে প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় করে চলেছে একের পর এক প্রতারণা। ঢাকায় এদের প্রধান কার্যালয়। অর্থ লোপাট, নারী নির্যাতনসহ নানান অভিযোগ রয়েছে ঢাকা অফিসের প্রধানের বিরুদ্ধেও।

হতদরিদ্র, অসহায় চা শ্রমিক ও পাহাড়িদের নগদ অর্থ, চাকরি, চিকিৎসাসেবা প্রভৃতির লোভ-প্রলোভন দেখিয়ে তাদের ধর্মান্তরিত করার অভিযোগ প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। এভাবে একজন বা শতজন নয়, শ্রীমঙ্গল এরিয়া অফিসের নেতৃত্বে মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার হাজার হাজার মানুষের অসহায়ত্বকে পূঁজি করে আন্তর্জাতিক দাতাদের কাছ থেকে কোটি কোটি আদায় করছে। ঢাকা ও আঞ্চলিক অফিসের একাধিক কর্মকর্তাও আজ কোটি কোটি টাকা মালিক বলে জানা যায়।

বাংলানিউজের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে শ্রীমঙ্গল এরিয়া অফিসের নানান দুর্নীতির তথ্য।

জত্না রানী কর বাংলানিউজকে বলেন, আমার বোন মারা যাওয়ার পর সাড়ে ৪ হাজার টাকা বেতনে আমাকে আমার বোনের কাজটাই দেওয়া হয়। কিন্তু তিন বছর কাজ করার হঠাৎ চাকরি চলে যায়। আমি বেকার হয়ে পড়ি। ৪/৫ মাস আগে ফের চাকরি দেওয়ার কথা বলে আমাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে। পরে আমি মৌলভীবাজার জর্জকোর্টে দুটি (মামলা নং- ২০১৬, ২০/১২/২০১৬ ইং) (মামলা নং-৩১৩, ০৪/১/২০১৭) মামলা করি। ন্যাজ্যারিন মিশন ও স্থানীয় শ্রীমঙ্গল ইউপি’র চাপে আমাকে নিশিতার জন্য মাত্র ৫০ হাজার টাকা দিলে (মামলা নং- ২০১৬, ২০/১২/২০১৬ ইং) মামলাটি তুলে নেই।

শুনেছি, আমার জন্য প্রায় দেড় লাখ টাকা দেওয়া কথা ছিল। কিন্তু মাত্র ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে।

স্থানীয় শ্রীমঙ্গল ইউনিয়ন প্রশাসনসহ শ্রীমঙ্গল থানা পুলিশও সহযোগিতা করছে ন্যাজারিনকে। সম্প্রতি সেই অফিসের ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী জত্না রানী কর ন্যাজারিন মিশনের মিহির বি‌শ্বাস, চন্দন রায়, দানিয়াল বাড়ই, মিলন পাঠোয়ারী ও জর্জ বারই- এই ৫ কর্মীর বিরুদ্ধে শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগে দু’টি মামলা দায়ের করেন। কিন্তু এ মামলার তদন্ত ও আপস-মীমাংসার নামে শ্রীমঙ্গল ইউপির জনপ্রতিনিধিরা আর্থিক সুবিধা নিয়ে দাঁড়িয়েছেন মিশনের পক্ষে।  

একই অবস্থা শ্রীমঙ্গল থানারও। মিশনের কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য টিম লিডারদের দেওয়া হয় মোটরসাইকেল। কথা ছিলো বেতন থেকে টাকা কেটে একসময় মোটরসাইকেলটি কর্মীর হয়ে যাবে। এমন একজন টিম লিডার রবি কস্তার সঙ্গে সাংবাদিকদের যোগাযোগের অজুহাতে চাপ দেওয়া হচ্ছে মোটরসাইকেল ফিরিয়ে দিতে। অথচ মোটরসাইকেলটি এখন তার হয়ে গেছে। এ কাজে নিজেরা ব্যর্থ হয়ে শ্রীমঙ্গল থানার সহাকারী উপ-পরিদর্শক (এসআই) কামাল উদ্দিনের সাহায্য নিয়েছেন। হুমকি-ধামকিও দিচ্ছেন তিনি।

শ্রীমঙ্গলে লোক ঠকিয়ে বিত্তশালী ন্যাজ্যারিন মিশন

নিঃস্ব, বিত্তহীন ও কর্মহীন মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কল্যাণই এ সংস্থার মূল উদ্দেশ্য। বাংলাদেশ ন্যাজ্যারিন মিশনের গঠনতন্ত্রে (ধারা-৫) এভাবেই এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য লিপিবদ্ধ রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১২ সাল থেকে শ্রীমঙ্গলে কার্যক্রম শুরু এ মিশনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ১২৭টি চার্চ। প্রতিটি চার্চে সদস্য সংখ্যা নূন্যতম ৩০জন। সে হিসেবে এর সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ হাজার ৮১০ জন।

ধর্মভিত্তিক কার্যক্রম ঢাকতে তারা কিছু সামাজিক কাজ যেমন- ছাগল-গরু, নলকূপ, বীজ প্রভৃতি বিতরণ করে। সিডিসি (চাইন্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার) নামে চলে শিশুদের ‌নিয়ে অপর একটি কার্যক্রম। গ্রামের হিন্দু-মুসলিম শিশুদের এ কার্যক্রমে নিয়ে এসে তাদের মিথ্যা ধর্মান্তরিত দেখিয়ে বিদেশি দাতাদের বোকা বানিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ন্যাজ্যারিন মিশন।

এছাড়াও মিশনের কতিপয় স্টাফের মাসের পর মাস বেতন আটকে রাখা এবং অবশেষে চাকরিচ্যুত করা সংস্থাটির নৈমিত্তিক ব্যাপার।
চা বাগানের প্রতিবন্ধী ব্যক্তি নির্মা বুনার্জী বলেন, দেখেন বাবু আমার একটি পা নেই। তারা বলেছিল আমার চিকিৎসা করে দেবে। কিন্তু কোথায় কি?

মিন্টু বিশ্বাস জানান, আমি দীর্ঘদিন এই মিশনের চাকরিতে ছিলাম। আজ আমার চাকরি নেই। পরিবার নিয়ে ঠিকমতো খেতে পারি না।  

শ্রীমঙ্গল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কেএম নজরুল বাংলানিউজকে বলেন, ন্যাজ্যারিন মিশনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পুলিশ জড়ানোর বিষয়টি আমি দেখছি।

শ্রীমঙ্গল ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা ভানু লাল রায় বলেন, ন্যাজ্যারিন মিশন কাছ থেকে শ্রীমঙ্গল ইউপির জনপ্রতিনিধিদের আর্থিক সুবিধা গ্রহণের বিষয়টি আমি জানি না।

এ বিষয়ে ন্যাজ্যারিন মিশন শ্রীমঙ্গল এরিয়ার কনভেনার মিহির বিশ্বাস বলেন, আমরা কাউকে জোর করে ধর্মান্তিরিত করি না। আর টাকা-পয়সার বিষয়ে ঢাকা হেড অফিস জানে। আমি কিছু বলতে পারবো না।  

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর সহকারী পরিচালক দেবব্রত মন্ডল বাংলানিউজকে বলেন, ভুক্তভোগীরা এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক অথবা ইউএনও বরাবর আবেদন করে কিংবা সরাসরি ওই সংস্থার বিরুদ্ধে মামলা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৬০৫ ঘণ্টা,  ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৭
বিবিবি/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।