ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

সিলেটে পাথর কোয়ারিতে দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২০৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৭
সিলেটে পাথর কোয়ারিতে দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল

সিলেট: সিলেটের পাথর কোয়ারিগুলো যেনো মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে। আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনকালে প্রাণ হারাচ্ছেন দিনমজুর শ্রমিকরা। প্রশাসনের নজরদারী থাকা স্বত্বেও পাথর উত্তোলন অব্যাহত রয়েছে। সেই সঙ্গে মৃত্যুর মিছিলও দীর্ঘ হচ্ছে।

প্রশাসন কি কারণে পাথর উত্তোলন বন্ধ ও মৃত্যুর মিছিল থামাতে পারছে না এনিয়েও জনমনে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রশাসনের আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

প্রশাসনের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, একমাসে পাথর কোয়ারিতে মাটিচাপা পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন ১৩ শ্রমিক। এলাকাবাসীর ভাষ্যমতে মৃতের সংখ্যা আরও বেশি। প্রশাসনের কঠোর নজরদারি না থাকায় পাথর-টিলা ধসে মৃতের সংখ্যা দিনদিন কেবলই বাড়ছে।
 
অর্থলোভী প্রভাবশালী মহল স্ব-স্ব এলাকার কোয়ারিগুলোতে আধিপত্য বিস্তার করে পাথর উত্তোলন অব্যাহত রেখেছে। অর্থের জন্য খেটে খাওয়া দিনমজুরদের জীবনের ঝুঁকি থাকা স্বত্বেও কোয়ারিতে পাথর উত্তোলন করতে নামানো হচ্ছে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৫/৬ ফুট গভীর হলে পাথর উত্তোলন ঝুঁকিপূর্ণ। সেখানে সিলেটের পাথর কোয়ারিগুলোতে ৫০/৬০ ফুটের বেশি গভীর থেকে শ্রমিকদের দিয়ে পাথর উত্তোলন করানো হচ্ছে। প্রশাসন কেন এসব ভয়ানকভাবে পাথর উত্তোলনকারী মালিকদের থামাতে গুলি করে না? এমন প্রশ্ন বিশেষজ্ঞদের। পাশাপাশি কোয়ারিগুলোতে আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়ন না করার প্রবণতাও সংশ্লিষ্টদের আদালত অবমাননার সামিল বলে মন্তব্য করেছেন পরিবেশ আইনবিদরা।

স্থানীয়দের দাবি অবৈধ পাথর উত্তোলন থামাতে প্রশাসনের ইচ্ছাই যথেষ্ট। কেননা অবৈধ পাথর উত্তোলনে জড়িতদের তালিকা প্রশাসনের হাতেই রয়েছে। এদের নিয়ন্ত্রক শক্তি কারা, তাদের ব্যাপারেও ওয়াকিবহাল প্রশাসন। এরমধ্যে ৪৭ জনের একটি তালিকা জেলা প্রশাসন থেকে পাওয়া গেছে।

স্থানীয়দের মতে, প্রশাসন অভিযানে বেরোনোর আগেই খবর পেয়ে পলিয়ে যান অবৈধ পাথর উত্তোলনকারীরা। অভিযানে ধ্বংসকৃত সরজ্ঞামাদির বেশিরভাগই থাকে পরিত্যাক্ত। যে কারণে অভিযানের নামে হয় আইওয়াশ।

তবে প্রশাসনের দাবি পাথর খেকোদের সঙ্গে তারা পেরে ওঠছেন না। অভিযান শেষ করে এলেই চোরাই পন্থায় পাথর উত্তোলন শুরু হয়।
 
গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সালাহ উদ্দিন আহমদ বাংলানিউজকে বলেন, ঝুঁকি নিয়ে পাথর উত্তোলন না করতে মাইকিং করে জানিয়ে দিয়েছি। এরপর শ্রমিকরা মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে পাথর উত্তোলন করে। তাছাড়া নদীর তীরে কোয়ারি বানিয়ে পাথর উত্তোলনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া আছে।

সিলেটের জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ার বলেন, অবৈধ পাথর উত্তোলনকারীদের ব্যাপারে আমরা খুবই কঠোর। পর্যায়ক্রমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে গোপনে পাথর তুলতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটছে বলে জানান তিনি।
 
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও পুরকৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. জহির বিন আলম বাংলানিউজকে বলেন, যেখানে ৫/৬ ফুটের নিচে গিয়ে পাথর উত্তোলন করা ভয়ানক ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়। সেখানে ৫০/৬০ ফুট তথা ৫ থেকে ৬ তলা সমপরিমাণ নিচে গিয়ে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। কোনো বিজ্ঞানেই তা সমর্থন করে না। পাথরের স্তর (লেয়ার) তুলতে তুলতে লোভী হয়ে গেছে ওরা।

তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, গত চার বছরে কোয়ারিতে প্রায় ৬০ জন মারা গেছে। প্রশাসন কেন এ ব্যাপারে সচেতন হচ্ছে না। অবৈধ পন্থায় পাথর উত্তোলনকারীদের থামাতে প্রশাসনের গুলি মারা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) সিলেটের সমন্বয়ক শাহ শাহেদা আক্তার বলেন, আরেফিন টিলা নিয়ে ২০০৯ সালে উচ্চ আদালতে রিট করেছিলাম। রিটে স্থগিতাদেশ ছিল টিলা কাটা যাবে না। ২০১১ সালের নভেম্বরে সিলেটের ছয়টি উপজেলার টিলা কাটার ব্যাপারে রিট করেছি। এখানে বলা ছিলো টিলা কাটা নিষিদ্ধ, টিলাকে সংরক্ষণ করতে হবে। পাশাপাশি টিলার পাদদেশে বসবাসকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

তিনি বলেন, যেখানে আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে টিলা কাটা যাবে না, এরপর মানুষ মারা যাচ্ছেন, এজন্য প্রশাসনের নিস্ক্রিয়তাই দায়ী। আদালতের নির্দেশনা না মানায় দুর্ঘটনা ঘটছে মৃত্যুর ঘটনা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। প্রশাসনের নিস্ক্রিয়তার কারণে আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। নিস্ক্রিয়তাটাই আদালত অবমাননার পর্যায়ে পড়ে।

কোম্পানীগঞ্জে শাহ আরফিন টিলা ট্র্যাজেডির পর রোববার (১৯ ফেব্রুয়ারি) ফের কোয়ারি ধসে দুই শ্রমিক নিহত হন। ১১ ফেব্রুয়ারি শাহ আরেফিন টিলায় পাথর কোয়ারি ধসে একজন নিহত হন। ৯ ফেব্রুয়ারি বিছানাকান্দিতে পাথর উত্তোলনকালে কোয়ারি ধসে তিন শ্রমিক নিহত হন।

২৩ জানুয়ারি আরফিন টিলায় পাথর কোয়ারিতে মাটি চাপায় গুমের চেষ্টাকালে পাঁচ শ্রমিকের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ প্রশাসন। এরপরও থেমে নেই অবৈধ পাথর উত্তোলন।

বাংলাদেশ সময়: ০৪০৫ ঘণ্টা,  ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৭
এনইউ/এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।