ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

ক্ষতিগ্রস্তরা কি বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবেন?

বিশেষ সংবাদদাতা | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৭
ক্ষতিগ্রস্তরা কি বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবেন? ক্ষতিগ্রস্তরা কি বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবেন?

ক্ষতিগ্রস্তরা কি বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবেন? পদ্মাসেতুর দুর্নীতি মামলা কানাডীয় আদালতে খারিজ হয়ে যাওয়া, আর সব আসামি দুর্নীতি-ষড়যন্ত্রের অভিযোগ থেকে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার পর সে প্রশ্নটিই এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এরইমধ্যে জার্মানির মিউনিখে ইউরোপ প্রবাসী বাংলাদেশিদের সামনে দেওয়া বক্তৃতায় বলেছেন, ক্ষতিগ্রস্তরা চাইলে বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন। কিন্তু সেটা কী করে সম্ভব! বিশ্বব্যাংককে তো বাংলাদেশে কোনও ধরনের জবাবদিহিতা থেকে ঢালাও অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

   

২০০৪ সালের ৪ জুলাই তখনকার বিএনপি-জামায়াত জোটের মন্ত্রিসভা সর্বসম্মতিক্রমে বিশ্বব্যাংককে এই বিশেষ সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। পরে ২০০৫ সালে তা জাতীয় সংসদে বিল উত্থাপন করে তখনকার জোট সরকার। এতে বলা হয়- বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংক তার সেবা গ্রহণকারী কারো কাছেই কোনও বিষয়ে জবাব দিতে বাধ্য নয়।  

ইন্টারন্যাশনাল ফাইনান্সিয়াল অরগানাইজেশনস (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট নামের এই বিলের আওতায় সে সময়ে বিএনপি-জামায়াত জোটের মন্ত্রিসভা আরও সিদ্ধান্ত নেয় যে, বিশ্বব্যাংকের কোনও বিষয় বাংলাদেশে কখনোই কোনও আদালতে নেওয়া যাবে না। বাংলাদেশের সরকার কিংবা জনগণের কাছে বিশ্বব্যাংক তার কোনও কৃতকর্মের জন্যই দায়বদ্ধ থাকবে না।  

১৯৭২ সালে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম সরকারের গৃহীত আইন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থা অধ্যাদেশ ১৯৭২ সংশোধনে এমন একটি সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে সে সময়ের সরকার দেশের সার্বভৌমত্ব, সংবিধান, জবাবদিহিতা, অংশগ্রহণমূলক আইনের শাসন ব্যবস্থাকে গভীর সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছিলো।

বহুল আলোচিত ওই সংশোধনী বিলটি নিয়ে ২০০৫ সালের মে সংসদে আলোচনা হয়। এর আগে ২০০৪ সালের ৩১ অক্টোবর তখনকার অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান বিলটি উত্থাপন করেন। সে সময় প্রধান বিরোধী দলে থাকা আওয়ামী লীগ কঠোরভাবে এই আইনের বিরোধিতা করে। কিন্তু আইনটি পাশ করিয়ে নিতে সাইফুর রহমান ছিলেন বদ্ধপরিকর।  

ঠিক আগের মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া এই সংশোধিত আইনের কঠোর বিরোধিতা করছিলেন। তিনি এই বিলকে অাপত্তিকর, অযৌক্তিক, অনৈতিক ও অপ্রয়োজনীয় বলেও মত দিয়েছিলেন। তিনি এও বলেছিলেন এমন একটি আইন পাশ করা হলে বিশ্বব্যাংক যে সুবিধা পাবে তাতে দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন হবে। তিনি তখন এও জানিয়েছিলেন, দক্ষিণ এশিয়ার কোনও দেশেই বিশ্বব্যাংক এই সুবিধা পায় না। আর এম সাইফুর রহমানের তখন যুক্তি ছিলো, এমন একটি আইনের অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের কার্যক্রম সাবলীল করে তুলতেই এই সংশোধনী প্রয়োজন।  

জাতীয় সংসদে যখন এই আইনটি নিয়ে তর্ক চলছে, তখন বাইরে বাংলাদেশের আদালতে বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে একটি মামলা চলছিলো। চাকরিচ্যুতির বিরুদ্ধে মামলাটি করেছিলেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের তখনকার এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স প্রধান ইসমাত জেরিন খান।       

ইসমাত জেরিন অবশ্য তার মামলাটি করেন ২০০১ সালে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরই বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ সরকারের কাছে যে কোনও আইনি প্রক্রিয়া থেকে ঢালাও অব্যাহতি চায়। এরই ধারাবাহিকতায় সরকার বিলটি প্রথমে মন্ত্রিসভায় পাস করে, পরে সংসদে উত্থাপন করে। তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল এবং আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ নিয়েই বিলটি সংসদে উত্থাপন করা হয়।  

এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে যখনই কোনও দেশের কোনও সহযোগিতা চুক্তি হয় তখনই আন্তর্জাতিক এই প্রতিষ্ঠানটি আইনি প্রক্রিয়া থেকে কিছু ছাড় পায়। তবে সে ছাড় কিংবা অব্যাহতি প্রতিষ্ঠানটির কোনও কর্মীর বিষয়ে প্রযোজ্য, একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্বব্যাংক তা পাবে না। ১৯৭২ সালের আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থাসমূহ অধ্যাদেশ তার ভিত্তিতেই জারি করা হয়েছিলো। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত সে অধ্যাদেশ সংশোধন করে বিশ্বব্যাংককে প্রতিষ্ঠান হিসেবে অব্যাহতি দিতে ছিলো বদ্ধপরিকর।    

ইসমাত জেরিন খানের মামলাটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে এই মত দিয়েই ওই আইনের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছিলেন সাইফুর রহমান।

আওয়ামী লীগের জোর দাবির মুখে তখন সংসদীয় একটি বিশেষ মূল্যায়ন কমিটি গঠনও করা হয়। আর ২০০৫ সালের ৩০ এপ্রিল সংসদীয় ওই কমিটির পক্ষ থেকেও বিলটি পাসের পক্ষে মত দেওয়া হয়।

কিন্তু পরে ২০১০ সালে নিজের পক্ষেই রায় পান ইসমাত জেরিন খান। ১০ বছর পর তিনি ন্যায়বিচার পান। সে সময় আদালত রায় দেন, বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে আদালতের শরণাপন্ন হওয়া যাবে। বিশ্বব্যাংকের অব্যাহতির নামে কোনও বিদেশি আইনের আমদানি চলবে না।

অব্যাহতি পেতে বিশ্বব্যাংক পরে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে যায়। সে আবেদন আমলে না নিয়ে পর্যবেক্ষণ দিয়ে দ্রুত মামলার চূড়ান্ত মীমাংসা করতে নিম্ন আদালতে পাঠিয়ে দেন আপিল বিভাগ।

এসব বিবেচনা থেকেই হয়তো প্রধানমন্ত্রী ভুক্তভোগীদের বলেছেন বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিতে। দেশীয় আদালতেই মানহানির মামলা করে ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারবেন তারা।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৭
এইচএ/এমএমকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।