ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

এ যুগের বিদ্যাসাগর!

আসিফ আজিজ, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০১৭
এ যুগের বিদ্যাসাগর! এ যুগের বিদ্যাসাগর!/ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: তেজগাঁও সাতরাস্তা সড়ক ধরে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ কানে এলো শিশুদের কিচিরমিচির। দৃষ্টি ফিরিয়ে দেখা গেলো কিচিরমিচির নয়, পড়ছে একদল শিশু। উপরে সিএনজি স্টেশনের এনার্জি লা‌ইটের ম্রিয়মান আলো। শীতের সন্ধ্যায় পাতলা ত্রিপলে বসে বিদ্যার্জন করছে তারা। গায়ে শীতের কাপড় নেই কারও। সেদিকে কোনো মনোযোগ বা কষ্ট আছে বলে দেখে মনে হলো না। চারদিকে গোল করে একজন যুবককে দেখা গেলো পড়াচ্ছেন। শিশুগুলোও পড়ছে মনোযোগ দিয়ে।

দূর থেকে কিছুক্ষণ দেখার পর আগ্রহ জাগলো বিষয়টি জানার। বিদ্যাসাগরের মতো ল্যাম্পপোস্ট না হোক, সিএনজি স্টেশনের আলোয় কারা পড়ছে বা পড়াচ্ছেন।

যিনি পড়াচ্ছিলেন তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানা গেলো নাম, শামীম হোসেন। ঢাকা পলিটেকনিক স্কুলের ফুড টেকনোলজির তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। ছিন্নমূল এ পথশিশুদের স্বেচ্ছায় পড়ান তিনি।

যেখান থেকে গ্যাস সরবরাহ করা হয় সেখানে অল্প জায়গায় বসা চাদর পরা একজন। শামীম বললেন, তিনিই চালান এ স্কুল। নাম ‘মুক্তির জন্য শিক্ষা স্কুল’।

স্কুল শুরুর গল্পটা জানা গেলো চাদর পরা সেই স্বপ্নবাজ তরুণ জিহাদ আরিফের কাছ থেকেই। একদিন তেজগাঁওয়ের একটি সরকারি আবাসিকের মাঠের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। মাঠে খেলছিলো কিছু শিশু। সেখানে একটি বস্তির শিশুও খেলার আগ্রহ প্রকাশ করে তাদের সঙ্গে। কিন্তু বস্তির শিশু বলে তাকে দলে নেওয়া হয় না। বিষয়টি নাড়া দেয় জিহাদকে। এদের জন্য কিছু করার কথা ভাবেন। মূলত তরুণ প্রজন্ম বাংলাদেশ নামে একটি সংগঠনের উদ্যোগ এটি। তবে স্কুলটির সব দায়-দায়িত্ব নিজেই নিয়েছেন জিহাদ।
এ যুগের বিদ্যাসাগর!/ছবি: বাংলানিউজবছর দুয়েক হলো চলছে এ স্কুলটি। কোনো অবকাঠামো নেই। অল ইন ওয়ান নামে ও পাম্পটি বন্ধ থাকে বিকেল ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। এসময়টি কাজে লাগানো হয়। প্রথম দিকে একটু সমস্যা হলেও ধীরে মানিয়ে যায়। প্রথম ছাত্র সেই মাঠের ছেলেটি। নাম শান্ত। এখন শিক্ষার্থী সংখ্যা ৪৩। তবে সবাই প্রতিদিন আসে না। একেবারে যারা ছোট শ্রেণিতে তাদের ক্লাসের নাম গোলাপ, শিশু শ্রেণির নাম মালতী আর ক্লাস ওয়ানের বাচ্চাদের ক্লাসের নাম রজনীগন্ধা।

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা জিহাদ নিজের খরচেই চালান এ স্কুল। বই কেনা থেকে শুরু করে খাতা-কলম। শিক্ষার্থীরা সবাই পথশিশু। দিনে তাদের কামাই করে পরিবারকে দিতে হয় নির্দিষ্ট অংকের টাকা। সন্ধ্যাটা কাটে পড়াশোনা করে। জিহাদের মতে, এরা তো আসলে ফুলের মতো। তাই ক্লাসগুলোর নাম দিয়েছি ফুলের নামে। এদের অনেকের মধ্যে দার্শনিকতা আছে। কথা বললে সেটা বুঝবেন।

আগ্রহ বাড়তে থাকলো আরও। আস্তে আস্তে সেই প্রথম ছাত্র শান্তর কাছে যাওয়া। জানা গেলো দিনে একটি মোটর কারখানায় কাজ করে সে। বেতন পায় ১৫শ টাকা। পুরো টাকাই দিয়ে দেয় মা-বাবার হাতে। পাঁচ ভাই-বোন, সে দ্বিতীয়। কারখানা থেকে যে হাতখরচ দেওয়া হয় সেটাই তার পুঁজি। এ থেকে খেয়ে-দেয়ে আরও জমায়।
এ যুগের বিদ্যাসাগর!/ছবি: বাংলানিউজবাবা-মা যত্ন করে? জানতে চাইলে বলে, মা করে। বাবা অতটা না। তবে দু’জনের জন্যই মায়া লাগে। আমি বড় হইয়া চাকরি করমু। তখন বাবা-মারে দেখমু। বাবা যত্ন না করলে তো বড় করছে। আমার একটা দায়িত্ব আছে না? বাবা-মা মরলেও তো আমারই কবর দেওয়া লাগবো। ছোট ভাইবোনদের দায়িত্বও তো নেওয়া লাগবো আমারই।

বোঝা গেলো জিহাদের কথার যথার্থতা। তিনি আরও বলছিলেন, এদের কেউ বাজে খরচ করে না। সবার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়ার চেষ্টা করছি।   একদিন দেখি একজন বাঁশের যে ফাঁকা অংশ তাকে তার মধ্যে টাকা জমিয়ে রাখে একজন। এটা দেখে উদ্বুদ্ধ হই।

এদের কেউ বলে, আমার ঢাকা থাকতে ভালো লাগে না। কেন লাগে না জানতে চাইলে বলে, এখানে কেউ আমাগো নাম ধইরা ডাকে না। এটা ভালো লাগে না।

ডলি, কান্তা, মজিদুল, তানজিরা কেউ ডাক্তার, কেউ চাকরি করতে চায় বড় হয়ে। কারও উদ্দেশ্য বাবা-মায়ের জন্য কিছু করা, কারও জমি কেনা।
এ যুগের বিদ্যাসাগর!/ছবি: বাংলানিউজএসব শিশুদের অধিকাংশই যমুনাপাড়ের। নদী ভাঙনে সব শেষ তাদের। পেটের টানে ঢাকা শহরে এসেছে এসব শিশুর পরিবার। কিন্তু বস্তিতে থেকেও শান্তি নেই। বস্তি উচ্ছেদের কবলে পড়তে হচ্ছে প্রায়ই। অনেকে ফিরে যাচ্ছে আবার গ্রামে।

তার স্কুলের ছেলেমেয়েরা সবাই জাতীয় সংগীত মুখস্ত বলতে পারে। অনেক ছড়া-কবিতা মুখস্ত তাদের। হাতের লেখাও একেকজনের ভালো। শীতের কাপড় কিনে দিলেও তারা পরে না। তাদের নাকি শীত লাগে না। স্বেচ্ছায় এ স্কুলে এসে যোগ দেয় তারা।

জিহাদ জানালেন, পাশের একটি সরকারি স্কুলের একটি রুম চেয়েছিলেন তিনি। কয়েক ঘণ্টার জন্য। কিন্তু ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক পিয়ন দিয়ে ফোন করিয়ে বলেন রুম দেওয়া যাবে না। এটা হলো অবস্থা। অনেক প্রতিকূলতা নিয়েই পড়াচ্ছেন তিনি। নিজের দায়বদ্ধতা থেকে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কারও সহযোগিতাও চাননি সেভাবে। শুধু বর্ষা-শীতের কষ্ট থেকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন একটি রুম। সেটা না পাওয়াও খুব আক্ষেপ নেই তার। স্কুল তো চলছেই!

বাংলাদেশ সময়: ২২৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০১৭
এএ/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।