‘এই সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান যেখানে আজ আমরা সমবেত হয়েছি’- কণ্ঠস্বরটি ভেসে আসছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে যেখানে সম্প্রতি স্বাধীনতার একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়েছে। আলো, শব্দ ও দৃপ্ত কণ্ঠস্বরের অপূর্ব সমন্বয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল সেদিন এখানে।
২৭ মার্চ রাতে আলো আঁধারিতে দাঁড়িয়ে আমিও দেখছিলাম অনুষ্ঠানটি। পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর বর্বরতার ইতিহাস বর্ণনায় যখন নিজের মধ্যে চরম ক্ষোভ জেগে উঠেছে, মানুষ নামের পশুদের নির্মম পৈশাচিকতায় ঘৃণায়-রাগে আমার সর্ব শরীর কাঁপছে; ঠিক তখনি দেখি আমার পাশে দাঁড়িয়ে পাকিস্তান ক্রিকেটদলের টি-শার্ট গায়ে দিয়ে আমারই মত এক তরণ অনুষ্ঠানটি দেখছে আর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে।
ব্যাপারটা চাক্ষুষ করে আমার মেজাজ বিগড়ে গেল। আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলাম না।
যে নামটি (পাকিস্তান) উচ্চারণ করতে ঘৃণায় আমাদের মন ভরে ওঠে, যে নামের মধ্যে আমরা আমদের নির্যাতিত নিষ্পেষিত মা-বোনদের হাহাকার শুনতে পাই, আমাদের মন তীব্র ঘৃণায় প্রতিশোধপরায়ণ হতে চায়, দলে-পিষে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা করে যে নামটি- সেই নামটি পরম মমতায় গায়ে জড়িয়ে বাংলদেশের কিছু মানুষ আজ গৗরবের হাসি হাসছে, কিভাবে?
‘পাকিস্তান’ নামটি আমাদের মনে রাখতে হবে, মনে রাখতে হবে যুগ যুগ ধরে কিন্তু তীব্র ঘৃণার সঙ্গে, মমতার সাথে নয়।
পাকিস্তানি ক্রিকেট খেলা কি ভুলিয়ে দিল আমাদের বুকের সমস্ত যন্ত্রণা, মুছিয়ে দিল বাংলামায়ের বুকের ক্ষত?
যে পিতার চোখের সামনে তার মেয়েটি ধর্ষিত হয়েছিল, যে মা নৃশংস বর্বরতার মুখে তার সন্তানকে বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়েছিল সে কী পারবে খেলার আনন্দে পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলে চিৎকার করতে? সে কী পারবে ‘মায়ের পেটের ভাই আবার ফিরে চাই’- এই স্থুল কথাটি উচ্চারণ করে সান্ত¡না পেতে? অথচ সেই পিতারই, সেই মায়েরই কিছু সন্তান আজ পাকিস্তানের পতাকা মাথায় বেঁধে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ!!!’ বলে আনন্দধ্বনি করছে। কী অদ্ভূত!
‘মায়ের পেটের ভাই আবার ফিরে চাই’ এই কথাটি একটি ১২ বছরের শিশু শুনেছিল ৪০ বছরের এক ব্যক্তির কাছে। অবুঝ শিশুটি সেদিন শুধু বলেছিল, ‘আচ্ছা, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান আমাদের এত মানুষকে হত্যা করল আর ক্রিকেটে তাকে আপনি সমর্থন করেন?’ তারই উত্তরে সে পেয়েছিল এই স্থুল উত্তরটি। সেদিন বুঝিনি, আজ বুঝি- একটা শিশুর মাথায় যে প্রশ্নটি এসেছিল তা ওই ৪০ বছর বয়সী ব্যক্তিটির মাথায় এল না কেন?
কেন এমন হল? কাদের জন্য এমন হল? কে দেবে এসব প্রশ্নের উত্তর? মুক্তিযুদ্ধের আবেদনটি কি তাহলে সত্যিই ফিকে হয়ে যাচ্ছে?
(অনিক মণ্ডল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমের একজন নিয়মিত পাঠক)