ঢাকা, শুক্রবার, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ মে ২০২৪, ০১ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

আশুলিয়ার ইটভাটায় কৃতদাসজীবন

অভিযানের বিলম্বে পালিয়ে গেলেন মালিকরা

সাঈদুর রহমান রিমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৪৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০১১
অভিযানের বিলম্বে পালিয়ে গেলেন মালিকরা

আশুলিয়া থেকে ফিরে : আশুলিয়া থানা থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরের নিভৃত পল্লী পাড়াগাঁও গ্রাম। গ্রামটির পূর্ব কোণে আশুলিয়া বিলের প্রায় ৫০ একর জায়গা জুড়ে গড়ে তোলা হয় একতা ব্রিকস নামের ইটভাটা।

এখানেই ৩০ শ্রমিককে দিনে কড়া পাহারার মধ্যে কাজ করানো হতো আর রাতে বেঁধে রাখা হতো পায়ে শিকল জড়িয়ে। এভাবে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় ক্রীতদাসের মতো তাদের বেঁধে রাখা হয় দীর্ঘ ২২ দিন।

ইটভাটা ঘেঁষা বাড়িঘরের বাসিন্দারা এ খবর জানতে পারেননি। অন্যদিকে আশুলিয়া থানার পুলিশ বিষয়টি জানলেও তা গুরুত্ব দেয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে।

অব্যাহত নিষ্ঠুরতা সইতে না পেরে বন্দীদশায় থাকা শ্রমিকদের মধ্যে ফয়সাল (১৮) নামে এক তরুণ বুধবার সকালেই ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান। এরপর থেকেই শ্রমিকদের মধ্যে কিছুটা গুঞ্জনের সূত্রপাত ঘটে। আত্মহত্যার চেষ্টাকারী তরুণ ফয়সালের পিতার নাম আবুল কাশেম গাজী, সাতক্ষীরার তালা থানার মূলগাছা সাহাপুর গ্রামে তাদের বাড়ি।

বন্দীদশা থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য ইটভাটারই আরেক শ্রমিক মহিদুল ইসলাম (৩০) মোবাইল ফোন করে নানা অত্যাচার-নির্যাতনের কথা জানিয়েছিলেন নিজেরই ঘনিষ্ট আত্মীয়কে। মহিদুলের বাড়ি যশোর জেলার মনিরামপুর থানার আমিনপুর গ্রামে।

মহিদুল বাংলানিউজকে জানান, গত এক সপ্তাহ ধরেই তার খালাতো ভাই বেল্লাল হোসেনকে চুপিসারে ফোন করে এসব নির্যাতনের কথা তিনি জানাতেন। বেল্লাল বিষয়টি যশোর থেকেই টেলিফোনে আশুলিয়া থানা পুলিশকে জানান। বন্দী শ্রমিকদের উদ্ধারের জন্য সহায়তা চান। কিন্তু পুলিশ তার কথায় কোনো পাত্তা না দিয়ে জানিয়ে দেয়, প্রমাণসহ থানায় এসে লিখিত অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সে কথা শুনে বেল্লাল আর থানা পর্যন্ত যেতে সাহস পাননি।

বেল্লাল বলেন, ‘আমি কোত্থেকে প্রমাণ যোগাড় করবো? থানায় অভিযোগ করতে গিয়ে আবার নিজে কোন্ ঝামেলায় পড়ি...। ’

এরই মধ্যে ইটভাটা মালিক ওই শ্রমিক মহিদুলকে মোবাইল ফোন করতে দেখে তার মোবাইলটি কেড়ে নেয়। মহিদুলকেও পায়ে শিকল পরিয়ে তালাবদ্ধ করে রাখে। গত তিন দিন ধরে আর কোনো মোবাইল কল না পেয়ে বেল্লাল অজানা শংকায় মঙ্গলবার ঢাকায় এসে সরাসরি র‌্যাব-১ এর উত্তরাস্থ দপ্তরে পৌঁছেন। সেখানে র‌্যাব কর্মকর্তাদের কাছে পুরো ঘটনা বর্ণনা দেন। কিন্তু র‌্যাবও তাৎক্ষণিক অভিযান চালায়নি।

এ ব্যাপারে মেজর আহসান কবীর জানান, মৌখিক অভিযোগ পাওয়ার পর ঘটনাস্থলে গোয়েন্দা সদস্যদের মাধ্যমে খোঁজ-খবর নেওয়া হয়। অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত হওয়ার পরই ওই ইটভাটায় অভিযান চালানো হয়।

অভিযানে উদ্ধার প্রাপ্তরা জানান, বিকেলের দিকেও ইটভাটার মালিকরা ভাটায় ছিলেন। সন্ধ্যার আগেই তারা ভাটা ছেড়ে চলে যান। তবে ইটভাটার অফিসটিতে ভাটার ব্যবস্থাপক সুলতান মাহমুদ রতন, নৈশ প্রহরী হোসেন গাজী ও চারদিকে আরও কয়েকজন পাহারাদার ছিলেন। র‌্যাবের অভিযান মুহূর্তে চারদিকের পাহারাদাররা পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।

মালিকরা লাপাত্তা
র‌্যাবের অভিযান চলার সময়ই এলাকা থেকে লাপাত্তা হয়ে যান একতা ইটভাটার মালিকরা। বুধবার বিকেলে তারা ভাটা এলাকায় অবস্থান করলেও সন্ধ্যার পর পরই তারা গা ঢাকা দেন। স্থানীয়রা জানান, মালিকরা সবাই পাড়াগাঁও ও আপাশের গ্রামের বাসিন্দা। ইটভাটায় তাদের না পাওয়ায় র‌্যাব সদস্যরা ভাটা মালিকদের কারো বাড়িতে আর অভিযান চালায়নি।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, জায়েদুল, হযরত, জালাল, জুয়েল, বাসেক, বাবুল, সাইদুলসহ আট জন মিলে ২০০৩ সালে ‘একতা ব্রিকস’ নামের ইটভাটাটি গড়ে তোলেন। এদের মধ্যে হযরত খুবই সন্ত্রাসী শ্রেণীর মানুষ বলে তারা মন্তব্য করেন।

বন্দী থাকা শ্রমিকরা জানান, হযরত সব সময় অস্ত্র নিয়েই ভাটা এলাকায় আসা-যাওয়া করতো। অস্ত্র প্রদর্শন করে শ্রমিকদের ভয়ভীতিও দেখাতো। ইটভাটার অন্য মালিকরা তার ব্যবসায়িক ‘পার্টনার’ ছিলেন।

স্থানীয় পাওয়ার ব্রিকস নামে আরেক ইটভাটার মালিক সালাহউদ্দিন জানান, প্রতি বছর শ্রমিক এনে দেওয়ার নাম করে সর্দার বা দালালরা একেকজন ৫/৭ লাখ টাকা আগাম নিয়ে যায়। ইট বানানোর মৌসুমে বড়জোর ১০/১৫ জন শ্রমিককে ভাটার কাজে লাগিয়ে দিয়ে সর্দাররা লাপাত্তা হয়। তিনি দাবি করেন, ১০/১২ জন দালাল গত তিন বছরে একতা ইটভাটা থেকে অগ্রিম নিয়ে অন্তত ৫০ লাখ টাকা মেরে দিয়েছে। সালাহউদ্দিন আরও বলেন, ‘অনেক শ্রমিক আগাম ৮/১০ হাজার টাকা নিয়ে ভাটায় আসেন ঠিকই, ২/৪ দিন কাজ করেই পালিয়ে যান। এ অবস্থায় ইটভাটার মালিকরা দফায় দফায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

র‌্যাবের অভিযানকালে গ্রেপ্তারকৃত একতা ইটভাটার ম্যানেজার সুলতান মাহমুদ রতন জানান, পুরো ভাটায় দেড় শতাধিক শ্রমিক কাজ করে। বিভিন্ন মেল হিসেবে তাদের আলাদা আলাদা গ্রুপ বানানো হয়। এবারের মৌসুমে চারটি গ্রুপের ৩০ জন শ্রমিক আগাম টাকা নিয়েও কাজ না করে পালিয়ে যাওয়ার ধান্ধায় ব্যস্ত ছিলেন। এ কারণেই মালিকদের নির্দেশে ৩০ জনকে শিকল বেঁধে রাখা হতো বলেও স্বীকার করেন ম্যানেজার সুলতান মাহমুদ রতন।

গ্রেপ্তারকৃত নৈশ প্রহরী হোসেন গাজী জানান, তিনি পাহারাদার হিসেবে এ ইটভাটায় চাকরি করেন। মালিকদের নির্দেশে সব সময় হোসেন গাজী ধারালো দা হাতে নিয়ে শ্রমিকদের ভয় দেখাতেন, শাসাতেন বলেও স্বীকার করেন।

হোসেন গাজী বলেন, ‘এ দা দিয়ে কাউকে কোপানোর মতো কোনো কাজ আমি করিনি, তবে দায়ের ভোতা অংশ দিয়ে আঘাত করা হয়েছে ক’জনকে।

বাংলাদেশ সময় : ০৬৩৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।