ঢাকা, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

‘ও স্যার-আমার পায়ের শেকলডা আগে খুইলে দ্যান’

সাঈদুর রহমান রিমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩১৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০১১
‘ও স্যার-আমার পায়ের শেকলডা আগে খুইলে দ্যান’

আশুলিয়া থেকে ফিরে : গ্রামের নাম পাড়াগাঁও। ওই গ্রামের বিলের মধ্যে গড়ে তোলা একতা ব্রিকস নামের ইটভাটায় মধ্যযুগীয় কায়দায় কৃতদাসের মতো পায়ে শিকল বেঁধে রাখা ২৭ শ্রমিকের সঙ্গে ছিল নীপা আক্তার।

বয়স মাত্র ছয়। ওর পায়েও শিকল বেঁধে রাখা হয় ২২ দিন ধরে। নীপার বাবা আশরাফ আলীকে (৩৫) ওই ইটভাটার শ্রমিক (কৃতদাস) হিসেবে আর তার মা পারভীন আক্তারকে (২৪) দিয়ে রান্নার কাজ করানো হতো।

পারভীন আক্তারের পায়ে শিকল পরালে রান্নাবান্নার কাজে সমস্যা হয়, তাই মায়ের বদলে তার মেয়ের পায়ে শিকল পরানো হয়। ইটভাটা মালিক বলতেন, এক মেয়ের পায়ে শিকল পরানোর কারণে তার বাপ-মা দু’জনকে ছেড়ে রাখলেও সমস্যা নেই। কারণ, তারা নিজের মেয়েকে বন্দি রেখে সুযোগ পেলেও পালাতে পারবে না।

বুধবার রাতে র‌্যাবের অভিযানে পায়ে শিকল বাঁধা অবস্থায় ইটভাটার খুপড়ি ঘর থেকে নীপা ও তার মা-বাবাসহ ২৭ শ্রমিককে উদ্ধার করা হয়। এ সময় নীপা বারবার র‌্যাব কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে থাকে, ‘ও স্যার-আমার পায়ের শেকলডা আগে খুইলে দ্যান, দ্যাখেন পায়ে দাগ বইসে গেইছে, বিষ (যন্ত্রণা) করতেছে। ’

নীপাদের বাড়ি যশোর জেলার কেশবপুর থানার মঙ্গলকোট গ্রামে। হাফিজ নামে এক শ্রমিক সর্দারের খপ্পড়ে পড়ে নীপার বাবা আশরাফ আলী আশুলিয়া থানার পাড়াগাঁও গ্রামের একতা ইটভাটার শ্রমিক হিসেবে নিজের নাম লেখায়। পরে হাফিজের চাপাচাপি আর প্রলোভনে পড়ে আশরাফ আলী তার স্ত্রী পারভীন আক্তারকেও নিয়ে আসেন। তাকে দেওয়া হয় ভাটার বাবুর্চির চাকরি। মা-বাবা দু’জনে ইটভাটায় চলে আসায় তাদের সঙ্গে শিশু কন্যা নীপা ও শিশুপুত্র তানিয়ারকেও (দেড় বছর) নিয়ে আসেন তারা।

নীপার মা পারভীন আক্তার জানান, ইটভাটায় দিনভর হাড়ভাঙা খাটুনির পরও পান থেকে চুন খসলেই চলে অত্যাচার-নির্যাতন। গজারির লাঠি, রড, বৈদ্যুতিক তার জড়িয়ে বানানো বিশেষ লাঠি দিয়ে বেধড়ক পেটানো হয় শ্রমিকদের। প্রতি সপ্তাহে মজুরি দেওয়ার কথা থাকলেও ভাটা মালিক কোনো শ্রমিককে একটি টাকাও দেননি। এ অবস্থায় কয়েকজন শ্রমিক রাতের আঁধারে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকেই বাকি শ্রমিকদের ওপর নেমে আসে সীমাহীন অত্যাচার-নির্যাতন।
 
পারভীন হাতের কড়া গুণে জানান, ২১-২২ দিন আগে ভাটার মালিক হযরত, সাইদুল, জালালসহ কয়েকজন ষণ্ডাপাণ্ডা ভাটায় হাজির হয়ে ৩০/৩২ জন শ্রমিককে বেধড়ক পেটাতে থাকে। এক পর্যায়ে বড় শিকল এনে একসঙ্গে ৭/৮ জন শ্রমিকের পায়ে জড়িয়ে তালাবদ্ধ করে দেয়। আরও চার শ্রমিকের পায়ের সঙ্গে পারভীনকেও শিকল জড়িয়ে তালা দিয়ে রাতে খুপড়ি ঘরে ফেলে রাখা হয়। ঘরের বাইরে পালাক্রমে পাহারাদারও বসানো হয়। পরদিন অন্য শ্রমিকদের সঙ্গে শিকল বাঁধা অবস্থায় থাকার কারণে পারভীন রান্নাবান্নার কাজ করতে না পারায় হযরত এসে তার পা থেকে শিকল খুলে দেয়। কিন্তু ওই শিকলে বেঁধে ফেলা হয় পারভীনের মেয়ে নীপাকে। ফলে গত ২০/২১ দিন ধরেই নীপা তার পায়ে মোটা ও ভারি শিকল-তালা বহন করে বন্দীশালায় আটক ছিল।

র‌্যাবের অভিযানে তালাবদ্ধ শিকল থেকে উদ্ধার পাওয়া শ্রমিকরা সবাই হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। আর এক মুহূর্তও তারা কেউ ফাঁকা বিলের ইটভাটার অভিশপ্ত বন্দীশালার পাশে থাকতে চাননি। প্রায় সবাই আকুতি জানান, ওই মুহূর্তেই নিজ নিজ বাড়ি ফেরার জন্য।

তবে সেখানে উদ্ধার অভিযান পরিচালনাকারী র‌্যাব-১ এর মেজর আহসান বাংলানিউজকে জানান, বুধবার রাতেই উদ্ধার প্রাপ্তদের আশুলিয়া থানার হেফাজতে দেওয়া হবে। সেখান থেকে আত্মীয়-স্বজনদের জিম্মায় তারা নিজ নিজ বাড়িঘরে ফিরতে পারবেন।

বাংলাদেশ সময় : ০৩১১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

জাতীয় এর সর্বশেষ