ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

ফলোআপ: তবু সোহাগীরাই ক্ষমা করে...

সাঈদুর রহমান রিমন, আজিজুল হাকিম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৩৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২, ২০১০
ফলোআপ: তবু সোহাগীরাই ক্ষমা করে...

ঢাকা: ‘হ্যারা আমারে যতই মারুক, তাগোরে জেলে পাঠাইলেন ক্যান? এট্টু বকা-টকা দিলেই তো হইতো। খালা (লিমা খাতুন)-খালু (মশিউর রহমান) জেলে থাকলে আমি কার কাছে থাকমু?’

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিছানায় শায়িত ১২ বছরের শিশু সোহাগীর এমন কথা শুনে যে কারোরই লজ্জা হওয়ার কথা।

শুধু লজ্জা হয় না লিমা খাতুন আর আদম ব্যাপারী মশিউর রহমানদের মতো মানুষরূপী অমানুষদের।

যারা নিজের সন্তানের বয়সী গৃহকর্মীকে অমানুষিক নির্যাতন করে মেরে ফেলতেও দ্বিধাহীন। অথচ তাদের জন্যই প্রাণ কাঁদে সোহাগীর। অত্যাচারী গৃহকর্তার অমঙ্গল আশঙ্কায় কাতর সে।

তাই রাজধানীর দিলু রোডের বাসার নির্যাতন থেকে উদ্ধার পেলেও নির্যাতক গৃহকর্তার জন্যই দুশ্চিন্তা তার। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে সে কথাই বলছিল। তার করুণ অসহায়ত্ব দেখে হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের কর্তব্যরত ডাক্তার-নার্স-পুলিশ সদস্যদেরও চোখ ছলছল করে ওঠে।
 
দু’ বেলা দুটো ভাত আর মাথা গোঁজার একটু ঠাঁইয়ের জন্য ঢাকায় ছুটে এসেছিল সোহাগী। বাবা মারা যাওয়ার পর মা আরেক লোককে বিয়ে করে চলে যায়। আশ্রয়হীন সোহাগী এ বাড়ি ও বাড়ি ফুট ফরমাস খেটেও পেটের ক্ষুধা মেটাতো পারতো না। এ সময় এক আত্মীয় তাকে ঢাকায় আসার লোভ দেখায়। লোভ দেখায় ভালো খাওয়ার, ভালো থাকার, ভালো পরার।

তাই একদিন গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার ঘোনাপাড়া গ্রাম থেকে সে চলে আসে ২৭/১ দিলু রোডের ওই বাসায়। ভেবেছিল, ক্ষুধা থেকে, আশ্রয়হীনতা থেকে বুঝিবা মুক্তি মিলেছে তার ।  

তাই গৃহকর্তা-গৃহকর্ত্রীর মন যোগাতে এই শিশু বয়সেই দিনভর অমানুষিক পরিশ্রম করে গেছে সে। অথচ সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতিতে তার উপর নেমে আসতো বেধড়ক পিটুনি।

গৃহকর্ত্রী  লিমা খাতুন পান থেকে চুন খসলেই দিনে ৪/৫ বার চড় থাপ্পড় থেকে শুরু করে লাঠিপেটা করতেন। ভাগ্য আরো খারাপ হলে তার ছোট্ট দেহে পড়তো গরম খুন্তির ছ্যাঁকা ।

রাতে শুরু হতো পাষণ্ড গৃহকর্তা মশিউরের পালা। তিনি সোহাগীকে মারতে শুধু হাত-পা ব্যবহার করতেন না। লোহার রড ও বৈদ্যুতিক তার পেঁচিয়ে বানানো বিশেষ ছড়িও পড়তো সোহাগীর কোমল শরীরে।

গরম খুন্তির ছ্যাঁকা আর ছড়ির সপাং সপাং মারে সোহাগী যখন আর সহ্য করতে পারতো না, তখন কাঁদতো আর্তস্বরে। বাইরের লোকেরা যাতে সোহাগীর সেই আর্তনাদ শুনতে না পায়, সেজন্য মশিউর ও লিমা খাতুন মুখের ভেতর গামছা গুঁজে দিতেন।

এক সময় সোহাগী এতে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়তো। কাকপক্ষী দূরে থাক, পাশের ফ্ল্যাটের মানুষও তা শুনতে পেত না। তবে ধর্মের কল একদিন বাতাসে ঠিকই নড়েছে।

বাজার সদাই আনতে সোহাগী যখন নতুন নতুন মারের দাগ নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা করতে তখন তা আশপাশের লোকদের নজর এড়াতো না।

গত রোববার সকালে নির্যাতনকালে সোহাগীর গোঙানির আওয়াজ শুনে তারাই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে জানিয়ে দেন।

খবর পেয়ে র‌্যাব ও পুলিশ সদস্যরা একযোগে ছুটে যান দিলু রোডের সেই বাসায়। সোহাগীর ওপর নির্যাতনের মাত্রা দেখে উদ্ধারকারী র‌্যাব-পুলিশ সদস্যরাও আঁতকে ওঠেন।

তারা সোহাগীকে উদ্ধার করে তৎক্ষণাৎ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ভর্তি করেন। আটক করেন নির্যাতনকারী গৃহকর্তা ও গৃহকর্তীকে।

এ ব্যাপারে পুলিশ বাদী হয়ে রমনা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ আইনে মামলাও করে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রমনা থানার উপ-পরিদর্শক আব্দুল কুদ্দুস ফকির বাংলানিউজকে জানান, মশিউর রহমান ও লিমা খাতুনকে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। তারা দু’জনই সোহাগীর ওপর নির্যাতন চালানোর কথা স্বীকার করায় আর রিমান্ড চাওয়ার প্রয়োজন পড়েনি।

মঙ্গলবার গুরুতর আহত সোহাগীর খোঁজ নিতে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা জানান, শিশুটির ওপর যেভাবে নির্যাতন চালানো হয়েছে, তাতে ঘা শুকাতে ১০/১২ দিন সময় লাগবে।

দীর্ঘদিনের অবিরাম নির্যাতনে সোহাগীর সারা শরীরে ক্ষত অনেকটা স্থায়ী রূপ নিয়েছে বলেও মন্তব্য করেন চিকিৎসকরা।

অথচ সোহাগী বাংলানিউজকে বলে, ‘খালা-খালু জেলে থাকলে আমার কী হইব? আমি কার কাছে থাকমু? কে আমারে খাওয়াইব?’

এ প্রশ্নের উত্তর তাকে কে দেবে?

এই বিব্রতকর প্রশ্নের উত্তর তাকে কেউ দেয়নি বলেই কি  হাজারো অত্যাচারের পরও সোহাগী দিলু রোডের বাসাকেই এখনও আশ্রয়স্থল বলে জানে?

বাংলাদেশ সময় : ১৯৩২ ঘণ্টা, নভেম্বর ০২, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।