ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

ভোটের-কথা

জয়পুরহাট-১: রাজাকার পুত্রেই বিএনপির ভাগ্য!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২৮ ঘণ্টা, জুন ১১, ২০১৭
জয়পুরহাট-১: রাজাকার পুত্রেই বিএনপির ভাগ্য! জয়পুরহাট-১ আসনে ভোটের আলোচনা। ছবি: রহমান মাসুদ

জয়পুরহাট থেকে ফিরে: এমনিতেই বৃহত্তর বগুড়া জেলার অবিচ্ছেদ্য অংশ জয়পুরহাটকে ভাবা হয় বিএনপির শক্তিশালী ঘাঁটি। পূর্ব পাকিস্তান মুসলীম লীগ প্রধান মোহাম্মদ আলীর জন্মস্থানও ছিল প্রাচীন পুন্ড্র বর্ধন রাজ্যের এই অংশে। সে হিসেবে মুসলীম লীগের ঘাঁটিখ্যাত জয়পুরহাটে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটই চ্যালেঞ্জ হওয়ার কথা ক্ষমতাসীনদের জন্য। কিন্তু তা না হয়ে এখন এখানে বিএনপির শত্রু হয়েছে বিএনপি নিজেই।

বিএনপির সাধারণ কর্মীদের মতে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কেবল দলীয় কোন্দল আর আপোষকামিতায় আওয়ামী লীগের কাছ থেকে  নিজেদের ঘাঁটির কর্তৃত্ব পুন:উদ্ধার কঠিন হয়ে পড়বে বিএনপির জন্য। এ কোন্দলের পেছনে আছেন যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ও সাবেক মন্ত্রী কুখ্যাত রাজাকার মৃত আব্দুল আলীম পুত্র ফয়সল আলীম।

আগামী নির্বাচনে দল থেকে মনোনয়ন ছিনিয়ে নিতেই তিনি দলে বিভক্তি তৈরি করেছেন বলে অভিযোগ বিরুদ্ধ পক্ষের।
 
জয়পুরহাট জেলা বিএনপির ১ নং সদস্য ফয়সল আলীম ও জেলা সভাপতি মোজাহার আলী প্রধানের মধ্যে দ্বন্দ্বেই বিএনপি এখন নিজ ঘরে পরবাসী। মোজাহার আলী প্রধানের পরিবারতান্ত্রিক নেতৃত্বের কারণে সৃষ্ট পকেট কমিটি নিয়ে গৃহ বিবাদ ও ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আঁতাতেই দলের এই করুণ পরিণতি বলে অভিমত তৃণমূল নেতা-কর্মীদের। তবে মোজাহার আলী প্রধানের কাছের জনেরা বলছেন, দলের এই করুণ পরিণতির জন্য দায়ী রাজাকার পুত্র ফয়সল আলীম ও সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মোস্তফা। সর্বশেষ কেন্দ্র ঘোষিত জেলা কমিটি নিয়েই এ বিবাদের শুরু। এই কমিটিতে দলের অনেক পরীক্ষিত ও ত্যাগী নেতাকে দলের বাইরে রাখা হয়েছে। আবার কাউকে কেবল কমিটিতে রাখার জন্যই সাধারণ সদস্য করে রাখা হয়েছে।
 
তৃণমূল নেতা-কর্মীদের দাবি, আসন্ন নির্বাচনে জয়পুরহাট সদর ও পাঁচবিবি উপজেলা নিয়ে গঠিত জয়পুরহাট-১ আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে এখনো চারজনের নাম শোনা যাচ্ছে। এরা হলেন, মোজাহার আলী প্রধান, ফয়সল আলীম, অধ্যক্ষ শামসুল হক ও আব্দুল গফুর। এর মধ্যে মোজাহার আলী প্রধান বিতর্কিত জেলা কমিটির সভাপতি, ফয়সল আলীম কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য, অধ্যক্ষ শামসুল হক জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ও আব্দুল গফুর জেলার ১ নং যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক।
 কাঁচাবাজারেও ভোট
দেশের অতীত সংসদ নির্বাচনের ইতিহাস অনুযায়ী কেবল ১৯৮৬ সালের তৃতীয় সংসদ নির্বাচনেই সরাসরি ভোটে এ আসনে জয়ী হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী আব্বাস আলী মণ্ডল। ২৮ বছর পর ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এ আসনে নির্বাচিত হন জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও পাঁচবিবি পৌরসভার সাবেক মেয়র শামসুল আলম দুদু। এর আগে ৮৮’র ভোটার বিহীন চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন জাতীয় পার্টির ওলিউজ্জামান। এরপরই এ আসনের কর্তৃত্ব নেয় বিএনপি। এরমধ্যে এরশাদ পরবর্তী ১৯৯১ এর ৫ম সংসদ নির্বাচনে ও খালেদা জিয়ার স্বল্প মেয়াদি ৬ষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে জয়ী হন দলটির প্রার্থী গোলাম রাব্বানী। ৭ম ও ৮ম সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত হন বিএনপি প্রার্থী যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত সাবেক মন্ত্রী আব্দুল আলীম। ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে সারা দেশে বিএনপির ভরাডুবি হলেও এ আসনটি ধরে রাখেন জেলা বিএনপির বর্তমান সভাপতি মোজাহার আলী প্রধান।
 
স্থানীয় বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, ২০১৭ সালের ৩ মার্চ  জয়পুরহাট জেলা বিএনপির একটি আংশিক কমিটি ঘোষণা হয় ঢাকা থেকে। আগে থেকেই এ কমিটির সদস্যরা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করে চলেছে। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে করা এ আঁতাতে বিএনপি নেতারা দল ঘোষিত হরতাল ও অবরোধে সকাল থেকে ১০টা পর্যন্ত মাঠে থাকলেও পরে উধাও হয়ে যেতো। এরপর থেকেই রাজনীতির মাঠ দখলে থাকতো আওয়ামী নেতা-কর্মীদের দখলে। কিন্তু ২০১৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারির পর থেকে সেই পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়। সেদিন ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাইদ আল মাহমুদ স্বপনের উপস্থিতে ১৪ দলের শান্তি সমাবেশে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ বিস্ফোরণে জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী রেবেকা সুলতানাসহ ১৭ আওয়ামী নেতাকর্মী আহত হন। এ ঘটনার পর বিক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগ কর্মীদের হাতে ভষ্মিভূত হয় জেলা বিএনপির স্টেশন রোডের কার্যালয়। এরপর থেকে আর বিএনপিকে মাঠেই নামতে দেয়নি আওয়ামী লীগ। এ ঘটনার পর দলটির অনেক নেতাকর্মী এখনো পলাতক রয়েছেন। আবার যারা জামিনে মুক্ত হয়েছেন, তারাও টিকে আছেন ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আপোষ করে। দলের নেতাদের এই আপোষকামিতা মন ভেঙ্গেছে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের।
 
তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, এ বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্র ঘোষিত খণ্ডিত জেলা কমিটির সভাপতি করা হয় পুরনো সভাপতি মোজাহার আলী প্রধানকে। অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদক করা হয় সংস্কারপন্থি হিসেবে পরিচিত অ্যাডভোকেট নাফিজুর রহমান পলাশকে। জেলা বিএনপির এক নম্বর সদস্য করা হয় যুদ্ধাপরাধী আব্দুল আলীমের ছেলে ফযসল আলীমকে। মোজাহার আলী প্রধানের ছেলে ও জেলা ছাত্রদল সভাপতি মাসুদ রানা প্রধানকে করা হয় জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মোস্তফাকে করা হয় দলের সিনিয়র সহ-সভাপতি। এই কমিটিতে জায়গা হয়নি দলের অনেক সিনিয়র ত্যাগী নেতার। শহর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলজার হোসেনের মতো অনেককেই কমিটিতে রাখা হয়নি।
 
নতুন এই কমিটি ঘোষণা হওয়ার পরই তা বাতিলের জন্য আন্দোলনে নামেন সাধারণ সম্পাদক পদের দাবিদার সিনিয়র সহ-সভাপতি ও সাবেক এমপি প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা। তিনি ও তার অনুসারীরা এ কমিটির সাধারণ সম্পাদক নাফিজুর রহমান পলাশ ও সভাপতি মোজাহার আলী প্রধানের কুশপুত্তলিকা দাহ করেন এবং ক্ষেতলাল বিএনপি অফিসে তালা লাগান। একই দাবিতে জেলা বিএনপির কার্যালয়েও আগুন দেয়া হয়। খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ও সাবেক চিফ  হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের সামনে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার পর দুই পক্ষই থানায় মামলা করে।
 
একাধিক জেলা ও থানা নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমান এই বিভক্তির মূলে রয়েছেন রাজাকার পুত্র ফয়সল আলীম। এক সময়ে আসনটি যেহেতু তার বাবার অধীনে ছিল, তাই এবার তিনি তা পুনরুদ্ধার করতে চান। এজন্যই জেলা সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্যর বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আঁতাতের অভিযোগ তুলে তিনি দলকে তাতিয়ে রেখেছেন। এই পরিস্থিতি সহজেই মিটমাটের কোন কোন সম্ভাবনা নেই। ফলে সদর ও পাঁচবিবি উপজেলা নিয়ে গঠিত জয়পুরহাট-১ আসন ১৯৮৬ এর নির্বাচনের পর সত্যিকারের নির্বাচনের মাধ্যমেই হয়তো থেকে যাবে আওয়ামী লীগের হাতে।
 
বাংলাদেশ সময়: ২১০০ ঘণ্টা, জুন ১১, ২০১৭
আরএম/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

ভোটের-কথা এর সর্বশেষ