ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

ভোটের-কথা

আ’লীগের পোয়াবারো কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫২ ঘণ্টা, জুন ৫, ২০১৭
আ’লীগের পোয়াবারো কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে ড. এম ওসমান ফারুক। ফাইল ফটো

করিমগঞ্জ ও তাড়াইল (কিশোরগঞ্জ) থেকে: নিয়ামতপুর বাজারের পর করিমগঞ্জের শেষ আর তাড়াইলের শুরু। যদিও কিশোরগঞ্জ শহর থেকে করিমগঞ্জ ও তাড়াইলে যাওয়ার আলাদা সড়ক আছে, তথাপি আমরা করিমগঞ্জ হয়ে গ্রামের ভেতর দিয়ে তাড়াইল যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বিভিন্ন জায়গার মানুষের সঙ্গে কথা বলে ভোটের চিত্র এবং তৃণমূলের রাজনীতির খোঁজ-খবর জানা উদ্দেশ্য।

করিমগঞ্জ বাজার পেরিয়ে খানিক পুবে নিয়ামতপুর বাজার। জায়গাটা একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট।

নিয়ামতপুর থেকে একটি রাস্তা বায়ে মোড় নিয়ে উত্তর দিকে চলে গেছে কাজলা-দামিহা হয়ে তাড়াইলের দিকে। আরেকটি পথ সোজা পূর্ব দিকে চামড়াঘাট হয়ে হাওরাঞ্চলের দিকে গেছে। আমরা তাড়াইলের দিকের পথটি ধরে কিছু দূর এগিয়ে থেমেছি বাজারের শেষ প্রান্তে। রোজার কারণে চায়ের দোকান খুলে নি; সকালের চা-নাস্তার হৈচৈ নেই।

দেখা গেল,  টেইলারিং মাস্টারের একটি দোকানে কয়েকজন পত্রিকা পড়ছেন। সামনে রাস্তার দুই পাশে কিছু তরুণ পোস্টারিং করছে সাবেক জনপ্রিয় চেয়ারম্যান মোস্তফা ফারুকের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে একটি অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ জানিয়ে। চাঞ্চল্য বলতে আলাদা হট্টগোল নেই। বাজারে বেশ একটা শান্ত শান্ত ভাব।

টেইলারিং শপে বসা বাচ্চু মিয়া কৃষক লীগ করেন। তিনিই কথা বলছেন বেশি। খোঁজ-খবরও রাখেন ভালোই। ভোটের কথা তুলতেই তার সরস গলার আওয়াজ বড় হল, ‘এই আসনে আওয়ামী লীগের পোয়াবারো। বিএনপি ভালো নেই। ’ জানতে চাইলাম, ‘কেন এ অবস্থা? এখানে তো আওয়ামী লীগ বা বিএনপির বদলে সংসদ সদস্য হয়েছে জাতীয় পার্টি থেকে। তারপরেও এমন অবস্থা কেন?’

খুলে বললেন বাচ্চু মিয়া, ‘কিশোরগঞ্জ-৩ (করিমগঞ্জ-তাড়াইল) আসনে বর্তমানে জোটভুক্ত হয়ে জাতীয় পার্টির প্রার্থী সংসদ সদস্য হওয়ায় আওয়ামী লীগে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ এর ফলে সাংগঠনিকভাবে এক হয়েছে যে কোনও মূল্যে দলীয় প্রার্থী পাওয়ার আশায়। বিএনপির ড. ওসমান ফারুকের মনোনয়ন প্রায়-চূড়ান্ত ছিল বলে অনেকেই মনে করেন। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ উত্থাপনের পর রাজনীতি থেকে নিখোঁজ হয়ে দেশত্যাগ করায় তার মনোনয়নের বিষয়টি আপাতত বিবেচনায় আসছে না। ফলে আওয়ামী লীগের চরম সুযোগ রয়েছে আসনটি ফিরে পাওয়ার। ’
ড. ওসমান ফারুক প্রসঙ্গ এই আসনে বেশ তাজা। দলকে তিনি পকেটে পুরে রেখেছিলেন, তাই তার অবর্তমানে বিএনপি নাজুক অবস্থায় আছে বলে স্থানীয় সমর্থক-কর্মীরা মনে করেন। পরে জেলা সদরে বিএনপির এক নেতার কাছে বিষয়টি জানতে চেয়েছিলাম। তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ড. ওসমান ফারুক দলের চেয়ে নিজের রাজনীতি করেছেন বেশি। তিনি এখন কোথায়, অফিসিয়ালি কেউ জানে না। ১৯৭১ সালে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা কালে তিনি পাকিস্তানি আর্মির দোসর হিসাবে যুদ্ধাপরাধে অংশ নেন বলে অভিযোগ ওঠার পর থেকে কোনও আত্মপক্ষ সমর্থন না করেই গা ঢাকা দিয়েছেন। এতে দলের ইমেজ প্রচণ্ডভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। দল ভোটের মাঠে দাঁড়ানোর নৈতিক বল হারিয়েছে। ’
‘বিএনপি তাহলে কাকে প্রার্থী করবে?’ অনেকের কাছে প্রশ্নটি উত্থাপন করে জাহাঙ্গীর মোল্লার নাম জানা যায়। ছাত্রদল, যুবদলের রাজনীতির অভিজ্ঞতা সম্পন্ন জাহাঙ্গীর মোল্লা সূচনাকাল থেকেই কিশোরগঞ্জ বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। ওসমান ফারুক রাজনীতিতে এসে জাহাঙ্গীর মোল্লাকে কোণঠাসা করে ফেলেন। দলের দুর্দিনে এখন মোল্লাই ভরসা বলে মনে করেন বিএনপিপন্থি লোকজন।

করিমগঞ্জ-তাড়াইলের মাঠে-ময়দানে অবশ্য এমন কথাও শোনা গেছে যে, আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী একজনের আত্মীয় যুদ্ধাপরাধ তদন্তের সঙ্গে জড়িত থাকায় ওসমান ফারুককে ফাঁসানো হয়েছে। তবে, সাথে সাথে এটাও বলাবলি হচ্ছে যে, সত্যি সত্যি অপরাধের সঙ্গে জড়িত না থাকলে তিনি সটকে গেলেন কেন? আত্মপক্ষ সমর্থন না করে অন্তর্ধানে চলে যাওয়া তার রাজনীতিকে বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।  
করিমগঞ্জের মতো তাড়াইলেও ভোটের আলোচনা সরব পাওয়া গেল। দুপুরের পর পর বাজারের মূল পয়েন্ট স্বপনের সেলুনে জমজমাট ভোটের আলাপে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীদের সম্পর্কে জানা গেল। ৫/৬ জন সম্ভাব্য প্রার্থীর মধ্যে লোকজন এ ক্ষেত্রে সাবেক সংসদ সদস্য ড. মিজানুল হক কিংবা জেলা আওয়ামী লীগ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহবুব ইকবালের পক্ষে মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন। ‘তবে মিজানুল হক বাকশাল গ্রুপের লোক হওয়ায় ডা. ইকবালের সম্ভাবনা বেশি। চিকিৎসক ও ক্রীড়ামোদী হিসাবে এই মুক্তিযোদ্ধার পক্ষেই দলের সর্বস্তরে সমর্থন বেশি। ’ এমন মন্তব্যই সাধারণ মানুষের মুখে।

তবে কোথাও কোথাও তরুণ আইনজীবী অ্যাডভোকেট মাখনের পক্ষে আওয়ামী লীগের একটি অংশকে বেশ সিরিয়াস মনে হলো। প্রচারে ও জনসংযোগে এই মনোনয়ন প্রত্যাশী প্রার্থী যথেষ্ট সাড়া জাগিয়েছেন। তার কথা জানতে চাইলে দেহুন্দা বাজারের একজন বললেন, ‘অ্যাডভোকেট মাখন আপাতত প্রধান প্রার্থী তালিকায় না এলেও তার ভবিষ্যত উজ্জ্বল। লেগে থাকলে এই তরুণ নেতার রাজনীতিতে স্থান করে নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ’
জানতে চাইলাম, ‘আওয়ামী লীগের পক্ষে বাকী মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তাহলে আলোচনায় আনা হচ্ছে না কেন?  পোস্টার, ফেস্টুন দেখে আর মানুষের সঙ্গে কথা বলে তো মাঠে-ময়দানে বেশ কয়েক জনের উপস্থিতির কথা জানা গেছে?’

এ প্রসঙ্গে কলেজ শিক্ষক আহমদ আলি মনে করেন, ‘নতুন টাকা হওয়ায় অনেকেই প্রার্থীতার জন্য মাঠে নেমে আসলে নিজের সম্মান ও পরিচিতি বাড়াচ্ছেন। ব্যবসা বা বিদেশে থেকে টাকা কামাই করে সেটার প্রমাণ রাখতে হলে কিছু তো করতে হয়। রাজনীতির মাঠে নামাটাই তাদের কাছে সহজ মনে হয়েছে। স্থানীয় কিছু টাউট তাদেরকে নিয়ে ঘোরাফেরা করে টাকা-পয়সা খসাচ্ছে। এরা আসলে রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত যোগ্যতায় ভোটের মাঠে বড় কোনও ফ্যাক্টর নয়। কিছু আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকা ও ফেসবুক ক্যাম্পেইনাররা টাকা নিয়ে এদের ছবি ছাপিয়ে ফালতু প্রচার চালাচ্ছে। ভোটের মূল লড়াইয়ে এরা আসতে পারবেন না। ’
কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে আওয়ামী লীগের সামনে খোলা মাঠ ও একতরফা সুযোগ এসে হাজির হওয়ার পটভূমিতে দৃশ্যপটের নেপথ্যে করিমগঞ্জ ও তাড়াইলের রাজনীতিতে অনেক কিছু ঘটে চলছে। ‘ফ্যাক্টর আসলে অন্যত্র’, আভাস দিলেন তাড়াইলের এক সাংবাদিক। ‘শেষ দিকে বর্তমান এমপি মজিবুল হক চুন্নু রাজনীতির বাতাস ধরে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করতে পারেন। তার কাছের লোকজন এমন আভাস দিচ্ছেন। কারণ, বিএনপি শক্তভাবে না থাকলে আওয়ামী লীগের সমর্থন তিনি পাবেন না। আওয়ামী লীগ নিজের প্রার্থী দিয়ে আসন ছিনিয়ে নিতে চাইবেই। সে অবস্থায় তার পক্ষে নিজস্ব সংগঠন ও কর্মী নিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পাড়ি দেওয়া প্রায়-অসম্ভব। তার দিক থেকে দলবদল করে আওয়ামী লীগে যোগদানের বিষয়টি মোটেও এড়িয়ে যাওয়া যায় না। ’
এই সম্ভাবনার বিরুদ্ধ মতও পাওয়া গেল। ‘এমন দলবদলের ফল চূড়ান্ত অবস্থায় ভালো না-ও হতে পারে। ’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন রাজনীতিবিদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘মজিবুল হক চুন্নু জাতীয় পার্টি থেকে একবার বিএনপিতে গিয়ে নমিনেশন চেয়েছিলেন। তাকে দেবে দেবে বলে শেষ পর্যন্ত নমিনেশন দলে নবাগত ওসমান ফারুককে দেওয়ায় চুন্নু সাহেব আবার জাতীয় পার্টিতে ফিরে আসেন এবং আওয়ামী লীগকে সঙ্গে নিয়ে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে বিজয়ীও হন। কিন্তু আবার তিনি দল বদলিয়ে আওয়ামী লীগে এলে আওয়ামী লীগের আগ্রহী প্রার্থীরা তাকে সাহায্য করবে এমন কোনও কারণ নেই। কেননা, বিএনপির প্রার্থীকে হারানোর জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পরিস্থিতি আর নেই ওসমান ফারুকের অনুপস্থিতিতে। ’
আওয়ামী লীগ কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে নিজস্ব-দলীয় প্রার্থী চায়, তৃণমূলের সর্বত্র এমন দাবি স্পষ্ট। দেশে দল ক্ষমতায় থাকলেও স্থানীয়ভাবে দলের সংসদ সদস্য না থাকায় স্বাভাবিকভাবেই নেতা-কর্মীরা সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে নেই। এবার সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজেদের এমপি পাওয়ার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা মরিয়া। ‘দলের মনোভাব ও আবেগের মূল্য না দিয়ে কেন্দ্র থেকে প্রার্থী চাপিয়ে দেওয়া হলে ফল ভালো হবে না’, এমন কথা প্রকাশ্যে বলতেও দ্বিধা করছেন না দলের লোকজন।
পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, একটু সতর্ক হলে আওয়ামী লীগ আসনটি নিজেদের কব্জায় নিতে পারবে। তবে ড. ওসমান ফারুকের অনুপস্থিতিতে বিএনপি কি পদক্ষেপ নেয়, সেটাও বিবেচনার বাইরে রাখলে চলবে না। সব মিলিয়ে কিশোরগঞ্জ-৩ আসনটি বেশ জটিল ও স্পর্শকাতর হয়ে উঠছে ক্রমশই। ভোটের মাঠের ইঙ্গিত সে তথ্যই জানাচ্ছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৪০ ঘণ্টা, জুন ৫, ২০১৭
জেডএম/

কিশোরগঞ্জ-২: উন্নয়নহীনতায় ক্ষুব্ধ ভোটার

কিশোরগঞ্জ সদরে সৈয়দ আশরাফই শেষ কথা

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

ভোটের-কথা এর সর্বশেষ