ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

লাইফস্টাইল

নবজাতক ও অন্যান্য শিশুদের শ্রবনেন্দ্রীয় পরীক্ষাকরণ

ডা: সাকেত আগারওয়াল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৪৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ৮, ২০১১

বিশ্বব্যাপী শ্রবণ ক্ষমতা লোপ পাওয়া রোগীর সংখ্যা আনুমানিক ৮০০ মিলিয়ন। এদের মাত্র এক তৃতীয়াংশের হিয়ারিং লস বা শ্রবণ শক্তি লোপ পায় অবসরকালীন সময়ে।

অর্থ্যাৎ এদের বৃহদাংশই শিশু বা কর্মক্ষম ব্যক্তি।

শব্দের ছন্দ কানে শুনতে পাওয়া জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। প্রতিদিনই আমরা কোন কোন ভাবে শব্দের সান্নিধ্য পেতে চাই - হতে পারে তা ভালবাসার বা কাছের মানুষের কথামালা বা প্রিয় কোন গানের সুর।

শ্রবণ শক্তি হচ্ছে যে কোন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা এবং সামাজিক কর্মকান্ডকে সচল রাখার মূল চাবিকাঠি। সংক্ষেপে শ্রবনেন্দ্রীয়ই আমাদেরকে অন্যদের সাথে সংযোগ স্থাপনে সহায়তা করে। একটি শিশুর ভাষাজ্ঞানের উন্নয়ন পুরোটাই নির্ভর করে তার শ্রবণ শক্তির সামর্থের উপর । একজন শিশু ঠিক যেমনটা শুনে অভ্যস্থ তার ভাষাজ্ঞানের মনোন্নয়নও সেরকমই হয় এবং এই প্রক্রিয়াটা শুরু হয় ভ্রুনের জরায়ুতে অবস্থান থেকেই।       

হিয়ারিং লস বা শ্রবণ শক্তি লোপ পেয়েছে এমন শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক উভয়কেই আমাদের সমাজে বিভিন্ন কলঙ্কজনিত অপবাদসহ তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয় এবং তাদেরকে আলাদা করে দেখা হয় । হিয়ারিং লসের চিকিৎসা না করালে আন্ত:সম্পর্কীয় এবং পারিবারিক বন্ধনেও মারাত্নক প্রভাব ফেলতে পারে। যা পরবর্তীতে মানসিক অস্থিরতার দিকে ধাবিত হয়ে হতাশা বা অবসাদ গ্রস্থতায় রূপ নিতে পারে। প্রাক স্কুলগামী শিশুর ক্ষেত্রে অপর্যাপ্ত শ্রবণ শক্তির কারনে কথা বলতে শিখতে না পারা তাকে সমাজে স্বাভাবিক অবস্থান থেকে অনেক দূরে ঠেলে দেয়।    

হিয়ারিং লস দেখা যায় না (অদৃশ্যমান)। শ্রবণশক্তি লোপ প্রাপ্ত ব্যক্তিরা এমন এক জগতে বাস করে, সেখানে অন্যরা তাদের নিকট স্বাভাবিক শ্রবণ প্রত্যাশা করে। তারা নিজেদেরকে পরিবারের লোকদের বা সহকর্মীদের বা অপরিচিতের নিকট অনেকটা উপহাসের পাত্র। অবহেলিত বা ক্ষোভের কারন হিসেবে মনে করে। ব্যাচেলর অব আটর্স ডিগ্রীপ্রাপ্ত বধির নারী হেলেন কেলারের মতে দৃষ্টিশক্তি হারানো মানে নিজেকে বস্তু বা জিনিষ থেকে পৃথক করা আর শ্রবণশক্তি হারানো মানে নিজেকে মানুষ থেকে পৃথক করা।

প্রতিবছর এক যুক্তরাজ্যেই প্রতি হাজারে ১/২ জন শিশু স্বাভাবিকের চেয়ে কম শ্রবণক্ষমতা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে যা তাদের স্বাভাবিক ভাষা শিক্ষা ও বোধশক্তির উন্নয়নকে প্রভাবিত করে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর প্রায় ১২০০০ শিশু হিয়ারিং লস নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে। শিশুদের কানে শোনার অসুবিধাটি পিতা-মাতাদেও একেবারে শুরুতেই সনাক্ত করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যাতে কম শুনতে পাওয়া শিশুদের মানানসই ভাষা শিক্ষা দেয়া যায় এবং তারা যাতে স্বাভাবিক শ্রবণক্ষমতা সম্পন্ন শিশুদের সাথে খুব সহজেই মেলামেশা বা ভাবের আদান প্রদান করতে পারে। অন্যথায় শিশুর হিয়ারিং লসের বিষয়টি বছরের পর বছর অনেকটা সময় ধরে অনাবিষ্কৃত থেকে যাবে এবং সমস্যাটি আরও তীব্রতর হবে, যখন সেই শিশুটি স্কুলে যাবে কিন্তু কথা বলা বিলম্বিত ও ল্যাংগুয়েজ স্কীল বা ভাষা দক্ষতা কম থাকার কারণে অন্যান্য সহপাঠিদের মত শ্রেনী ও বাডির কাজ সময়মত শেষ করতে পারবে না।

উন্নত বিশ্বে এবং কিছু কিছু উন্নয়নশীল দেশে জন্ম গ্রহনকালীন সময়ে বাধ্যতামূলকভাবে হিয়ারিং বা শ্রবনেন্দ্রীয়ের ক্ষমতা পরীক্ষা করা হয়। এ্যাপোলো হসপিটালস ঢাকার নাক, কান ও গলা বিভাগ ও নবজাতক শিশুদের হিয়ারিং স্ত্রীনিং বা শ্রবণেন্দ্রীয়র ক্ষমতা পরীক্ষাকরণ প্রোগ্রাম বা কর্মসূচী চালু করেছে। নবজাতক শিশুদের ক্ষেত্রে জন্ম গ্রহনের প্রথম বা দ্বিতীয় দিনেই হিয়ারিং প্রবলেম আছে কিনা তা স্ত্রীনিং করা হয়।

নবজাতক শিশু যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন এই পরীক্ষা করা হয় বিধায় এই পরীক্ষায় শিশু ব্যথা পায় না বললেই চলে। এই প্রক্রিয়ায় একটি ছোট সার্জিক্যাল যন্ত্র কানের ভিতর প্রবেশ করানো হয় এবং হালকা শব্দ প্রেরণ করা হয়। যদি কানে সেই শব্দের প্রতিধ্বনি তৈরি হয়, তাহলে তা সেই যন্ত্র সহজেই ধারণ এবং শব্দের প্রতিধ্বনি তৈরী হয়।   প্রতিধ্বনি তৈরী না হলেই যে আপনার শিশু শুনতে পায় না তা নয়, সেইক্ষেত্রে আরও অন্যান্য পরীক্ষার প্রয়োজন হয়, যেমন  এ আর বি যা শিশুর ঘুমকালীন সময়ে শব্দের প্রতিক্রিয়ায় মস্তিষ্কের প্রতিক্রিয়াশীল আচরণ প্রত্যক্ষ করে। এক্ষেত্রে শিশুর মাথায় হেডফোন সংযুক্ত করে তার মাধ্যমে শব্দ প্রেরন করা হয়। এই পরীক্ষাও সম্পূর্নরূপে ব্যথামুক্ত।

এখানে উল্লেখ্য যে, স্ত্রীনিং টেস্ট বধিরতা বা কানে কম শোনা সনাক্তকরনের পূর্বশর্ত নয় বরং এই পরীক্ষার মাধ্যমে নবজাতক শিশুদের মধ্যে বধিরতা বা কানে কম শোনার লক্ষণ আছে কি না তা বুঝতে পারা যায় বা আরও অন্যান্য পরীক্ষার প্রয়োজন কি না সে সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যায়। তবে কি কারণে নবজাতকের শ্রবনেন্দ্রীয় কাজ করছে না বা বধিরতার মাত্রা কতটুকু সে সম্পর্কে এই পরীক্ষা পর্যাপ্ত তথ্য সরবরাহ করে না। প্রসঙ্গগত উল্লেখ্য, শুনতে সক্ষম এমন অনেক নবজাতকেরও সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন কারনে শ্রবণক্ষমতা ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে পারে।  

এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আপনার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন। এক গবেষনায় দেখা গেছে যে বধিরতার বা কানে কম শোনার লক্ষণ শুরুর ছয় মাসের পূর্বেই তা সনাক্ত করা সম্ভব হলে বিলম্বে সনাক্তকরণের চেয়ে অনেক বেশি প্রতিক্রিয়াশীল ফলাফল পাওয়া যায়।

যে সব শিশুদের হিয়ারিং লসের বা বধিরতার মাত্রা অনেক বেশি এর হিয়ারিং এইড বা শ্রবণ সহায়ক যন্ত্র দিয়েও যারা প্রতিক্রিয়াশীল বা প্রয়োজনীয় সাড়া দিতে পারে না তাদের জন্য কক্লিয়ার সার্জারি নামে আধুনিক চিকিৎসা রয়েছে। এ ধরনের সার্জারি সাধারনত দুই বছরের কম বয়সীদের করা হয়ে থাকে। এই প্রক্রিয়ায় বায়োনিক ইমপ্ল্যান্ট অন্তকর্ণের ভেতরের দিকে প্রবেশ করানো হয় এবং বাইরে বিদ্যমান যন্ত্রের সাথে তারবিহীন ভাবে সংযুক্ত করা হয়। সঠিকভাবে কথা বলতে পারা শেখার জন্য শিশুদের এক্ষেত্রে অনেক সময় স্পীচ থেরাপির প্রয়োজন হয়।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।