ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

আইন ও আদালত

খালেদার শুনানিতে যা হলো

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৮
খালেদার শুনানিতে যা হলো বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ফাইল ছবি

ঢাকা: নির্ধারিত ছিল বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আপিলের গ্রহণযোগ্যতার শুনানির জন্য। এ কারণে বৃহস্পতিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকেই হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের কোর্টে পক্ষ বিপক্ষের আইনজীবীরা ভিড় করতে থাকেন। এর সঙ্গে রয়েছেন গণমাধ্যমের কর্মীরা।

কোর্ট বসার আগেই কানায় কানায় পরিপূর্ণ আদালত কক্ষ। কিছু আইনজীবী ঢুকতে না পরে হৈ চৈও শুরু করে দেন।

এর মধ্যে ঠিক সাড়ে ১০টার দিকে কোর্ট বসেন। বসে আইনজীবীদের অবস্থা দেখে আদালত বলেন, ‘আপনারা কথা বলা বন্ধ করুন। প্লিজ কো-অপারেট করেন। কো-অপারেট না করলে কোর্ট থেকে নেমে যেতে হবে আমাদের। ’ 

এ সময় সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি জয়নুল আবেদীন সব আইনজীবীকে চুপ থাকতে বলেন।  এরপর আইনজীবীরা চুপ করলে কার্যক্রম শুরু হয় কোর্টে।

কিছুক্ষণ পরে ওই আদালতের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ফরহাদ আহমেদ বলেন, ‘খালেদা জিয়ার আবেদনটি কিছুক্ষণ আগে আমরা পেয়েছি। বেলা দুইটা পর্যন্ত শুনানি মুলতবি চাচ্ছি।
 
এসময় আদালত বলেন, ‘মুলতবি কি দরকার। আমরা আবেদনটি বেলা ১২টায় শুনবো। ’ এ কথা বলে আদালতে অন্য মামলার কার্যক্রম শুরু হয়।

তখন বেশির ভাগ আইনজীবী আদালত কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান। পরে সাড়ে ১১টার দিকে ফের আদালত কক্ষ কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়।
 
রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা ও মোমতাজ উদ্দিন ফকিরসহ কয়েকজন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল। দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী খুরশীদ আলম খান ও মোশারফ হোসেন কাজল।

খালেদা জিয়ার পক্ষে ছিলেন- ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, খন্দকার মাহবুব হোসেন, এ জে মোহাম্মদ আলী, জয়নুল আবেদীন, আব্দুর রেজ্জাক খান, মাহবুব উদ্দিন খোকন, সানাউল্লাহ মিয়া, ব্যারিস্টার আমিনুল হক, রাগীব রউফ চৌধুরী, সগীর হোসেন লিয়ন ও ব্যারিস্টার এ কে এম এহসানুর রহমানসহ কয়েক’শ আইনজীবী ।
 
এছাড়া বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনও আদালত কক্ষে উপস্থিত ছিলেন।
 
সাড়ে ১১টার পর আদালত বলেন, ‘আমরা তো ১২টায় শুনানির জন্য বলেছিলাম। আপনারা উভয় পক্ষই যেহেতু উপস্থিত হয়ে গেছেন, চাইলে শুনানি শুরু করতে পারেন। ’
 
এসময় জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘আমাদের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী এখনও আসার বাকি, পাঁচ মিনিট পরে শুরু করতে চাই। ’
 
এসময় আদালত কক্ষে বিএনপিপন্থী আইনজীবীসহ আইনজীবীদের হৈ চৈ বেড়ে গেলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম শুনানির জন্য সব পক্ষের আইনজীবীদের থেকে নির্দিষ্ট আইনজীবী উপস্থিত থাকার বিষয়টি নির্ধারণ করে দিতে বলেন।
 
অ্যাটর্নি জেনারেলের এ বক্তব্যের পর আদালত জয়নুল আবেদীনের কাছে এ বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অ্যাটর্নি জেনারেল একটি সাবমিশন রেখেছেন আমি কিছু বলতে চাই না। কিন্তু আমরা কোনোদিন দেখিনি আইন কর্মকর্তায় কোর্ট ভরে যায়। অ্যাটর্নি জেনারেল একাই যথেষ্ট। অথচ ডিউটি ফেলে রেখে সব আইন কর্মকর্তা এখানে চলে এসেছেন। ’

আরও পড়ুন>>
** 
হাইকোর্টে খালেদার আবেদন গ্রহণ, জামিন শুনানি রোববার
 
এসময় হৈ চৈ আরও বেড়ে গেলে আদালত বলেন, ‘আপনারা কি করবেন, না করবেন দেখেন। আমরা বিরতিতে যাচ্ছি। ’
 
আদালত নেমে গেলে হট্টগোল আরও বেড়ে যায়। এসময় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আসন থেকে উঠে আইনজীবীদের হৈ চৈ থামানোর চেষ্টা করেন। ১২টার দিকে আদালত বসলে জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘আমাদের জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা উপস্থিত রয়েছেন। তবে শুনানি করবেন এ জে মোহাম্মদ আলী। ’
 
শুনানির শুরুতে এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আমাদের আপিল শুনানির জন্য গ্রহণের আবেদন করছি। আপিল গ্রহণ হলে জামিন আবেদন দেওয়া হবে। ’
 
আদালত বলেন, ‘অ্যাডমিশনের (শুনানির জন্য আপিল গ্রহণের আবেদন) আবেদনে কী আছে? না শুধুই আপিল অ্যাডমিশন চেয়েছেন?’
 
জবাবে এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘একটা আপিল অ্যাডমিশনের আবেদনে নরমালি যা যা থাকে আমরা তাই চেয়েছি। ’
 
আবেদন দেখে আদালত বলেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী সাজা বা দণ্ড স্থগিতের বিধান আছে। কনভিকশন কি স্থগিত করা যায়? ক্রিমিনাল অ্যাক্ট ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্টে কনভিকশন স্থগিতের বিধান নাই। আপনারা তো সাজা স্থগিতের পাশাপশি কনভিকশনও স্থগিত চেয়েছেন। ’
 
এ সময় মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘এটা গতানুগতিক, এটা ঠিক করে দেবো। সাধারণত এটা একটা প্রথা। ’
 
এরপর আদালত আপিল শুনানির জন্য গ্রহণের আদেশ দেন এবং আদেশ পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে বিচারিক আদালতকে মামলার নথি পাঠানোর নির্দেশ দেন ও আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত খালেদা জিয়ার অর্থদণ্ড স্থগিতেও আদেশ দেন।
 
এরপর এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘পনের দিন ধরে তিনি (খালেদা জিয়া) কাস্টডিতে আছেন। যেহেতু তাকে শর্ট সেনটেন্স (অল্প সাজা) দেওয়া হয়েছে। সে জন্য আমরা তার বেইল (জামিন) চাচ্ছি। বয়স, সামাজিক অবস্থান বিবেচনায় তিনি জামিন পাওয়ার অধিকার রাখেন। ’ 
 
শুনানির পর আদালত অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য শুনতে চান। তখন মাহবুবে আলম বলেন, ‘আপিল ইতোমধ্যে আদালত গ্রহণ করেছেন। আজকে সকালে আমরা জামিন আবেদন পেয়েছি। রেকর্ড (বিচারিক আদালতের নথি) আসার পরই বিষয়টি (জামিন আবেদন) কার্যতালিকায় এনে শুনানি করা হোক। এই মামলায় মেরিট আছে। এ কারণে এটা আমরা কার্যতালিকায় এনে শুনানি করতে চাই। ’
 
পরবর্তীতে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান আদালতে বলেন, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ এর ধারা ৩৩(৫) অনুযায়ী আমাদের যুক্তিসঙ্গত সময় দেওয়ার কথা বলা আছে। ’
 
দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ধারা ৩৩ (৫)-এ বলা হয়েছে, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক দায়েরকৃত মামলায় অথবা দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক গৃহীত যে কোনো কার্যক্রমের যে কোনো পর্যায়ে কোনো আদালতে কেহ কোনো প্রতিকার প্রার্থনা করিলে দুর্নীতি দমন কমিশনকে পক্ষভুক্ত করিতে হইবে এবং দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক দায়েরকৃত কোনো মামলায় বা কার্যক্রমে কোনো ব্যক্তি জামিন কিংবা অন্য কোনো প্রকার প্রতিকার প্রার্থনা করিলে কমিশনকে শুনানির জন্য যুক্তিসঙ্গত সময় প্রদান না করিয়া শুনানি গ্রহণ করা যাইবে না। ’
 
এ ধারাটি দেখিয়ে খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘এ ধরনের বিশেষ আইনের মামলার ক্ষেত্রে দুদককে যুক্তিসঙ্গত সময় দিয়ে শুনানি করতে হবে। গতকাল (বুধবার) রাত সাড়ে আটটায় আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া আমাকে ফোনে ইনফর্ম করেন যে, তারা আবেদনটি অ্যাফিডেবিট করাতে পারেননি। তাই আজ ৯টা ৩১ মিনিটে জামিনের আবেদনটি আমাদের কাছে সরবরাহ করা হয়েছে। ’
 
আদালত বলেন, ‘তারা তো অন মেরিট জামিন চাচ্ছে না। পুরো রেকর্ডের কি দরকার আছে?’
 
খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘ফৌজদারি আইন ব্যবস্থায় নারী বলে আদালত জামিনের বিষয়টি বিবেচনা করতে পারেন। কিন্তু দুদক আইনে সে সুযোগ নেই। জামিনের আবেদন অনেক বড়, গ্রাউন্ডও অনেক। আমরা চাচ্ছি কার্যতালিকায় এনে শুনানি করা হোক। ’
 
এ সময় এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘সাধারণত কম সাজা হলে আপিল করলে জামিন দিয়ে দেওয়া হয়। ’
 
আদালত বলেন, ‘আপিল বিভাগের অনেক আদেশ আছে কম সাজা হলে জামিন দিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সেগুলো এসব স্পেশাল আইন প্রণয়নের আগে। যেহেতু দুদক আইনে আছে তাদের যুক্তিসঙ্গত সময় দেওয়ার, তাই আমরা রোববার দুপুর ২টায় শুনানির জন্য রাখলাম। ’
 
এ আদেশ দিয়ে আদালত দিনের কার্যক্রম শেষ করেন।
 
খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনে কি আছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইনজীবী রাগিব রউফ চৌধুরী সগীর হোসেন লিয়ন বলেন, ‘৩২টি গ্রাউন্ডে জামিন আবেদনটি করা হয়েছে। ৪৮ পৃষ্ঠার গ্রাউন্ড ও মামলার আনুষঙ্গিক নথিপত্রসহ জামিন আবেদনটি মোট ৮৮০ পৃষ্ঠার।  

এ আবেদনে  বলা হয়, আবেদনকারীর বয়স ৭৩ বছর। তিনি শারীরিকভাবে বিভিন্ন জাটিলতায় ভুগছেন। তিনি ৩০ বছর ধরে গেঁটে বাত, ২০ বছর ধরে ডায়াবেটিস, ১০ বছর ধরে উচ্চ রক্তচাপ ও রক্তে আয়রণ স্বল্পতায় ভুগছেন।

তাছাড়া ১৯৯৭ সালে তার বাম হাঁটু প্রতিস্থাপন করা হয়েছে এবং ডান পায়ের হাঁটু ২০০২ সালে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। শারীরিক এসব জাটিলতার কারণ বিবেচনায় নিয়ে তার জামিন মঞ্জুরের সবিনয় আবেদন জানানো হয়।  

জামিন আবেদনের ফাইলিং আইনজীবী হচ্ছেন ব্যারিস্টার নওশাদ জমির।

৮ ফেব্রুয়ারি (বৃহস্পতিবার) ঢাকার বকশীবাজার কারা অধিদফতরের প্যারেড গ্রাউন্ডে স্থাপিত আদালতের বিশেষ জজ ৫ এর বিচারক ড. মো. আখতারুজ্জামান দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার ৫ বছর কারাদণ্ডের রায় দেন।  

একই সঙ্গে দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদাপুত্র তারেক রহমানসহ অপর পাঁচ আসামির ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সাজা ঘোষণার পর থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়েছে।
 
রায় ঘোষণার ১১দিন পর ১৯ ফেব্রুয়ারি বিকেলে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা রায়ের সার্টিফায়েড কপি বা অনুলিপি হাতে পান। ২০ ফেব্রুয়ারি আপিল করেন খালেদা।

বাংলাদেশ সময়: ১২২৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৮
ইএস/এমএ 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।