ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

আইন ও আদালত

‘আমরা মূল সংবিধানে ফিরে যেতে চাই’

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪৯ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০১৭
‘আমরা মূল সংবিধানে ফিরে যেতে চাই’

ঢাকা: ‘আমরা মূল সংবিধানে ফিরে যেতে চাই। এটি (সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান) সাংবিধানিক ইতিহাসের লজ্জা’ বলে মন্তব্য করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

ষোড়শ সংশোধনীর আপিল শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপনকালে এ মন্তব্য করেন তিনি।

সংসদের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল শুনানিতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেছেন উভয়পক্ষ।

এরপর অ্যামিকাস কিউরিদের (আদালতের বন্ধু বা আইনি সহায়তাকারী)   মতামত নিচ্ছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। অ্যামিকাস কিউরি ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম মতামত দেওয়া শুরু করেছেন।

বৃহস্পতিবার (২৫ মে) পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চ।

বুধবার আপিল শুনানির ষষ্ঠ কার্যদিবসে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। এরপর রিট আবেদনের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন মনজিল মোরসেদ।

যুক্তিতর্ক উপস্থাপনকালে মাহবুবে আলম বলেন, ‘আমরা মূল সংবিধানে ফিরে যেতে চাই। এটি (সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান) সাংবিধানিক ইতিহাসের লজ্জা। আমেরিকা-ভারতে মার্শাল ল’ হয়নি। আমাদের এখানে হয়েছে। মার্শাল ল’ এর মাধ্যমে যতোখানি হয়েছে ততোখানি বাদ দিতে চাই। বিগত সময়ে পারিনি’।
 
অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যের জবাবে মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘বাহাত্তরের সংবিধানের বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ যে সাবমিশন রাখা হয়েছে, সেটি ভুল ব্যাখ্যা। একটি সদ্য স্বাধীন দেশে যে সংবিধান তৈরি করা হয়েছিল, সে সময় কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না বলে এ বারের দু’জন  (ওই সময়ের মন্ত্রিসভার দু’জন সদস্য) সদস্য বলেছেন। তখন করা সংবিধানে বিচারকদের অপসারণের বিষয়টি সংসদের হাতে দেওয়া হয়েছিল’।
 
মনজিল মোরসেদ আরও বলেন, ‘১৯৭২ সালের সংবিধান বঙ্গবন্ধুর সংবিধান। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হাতে করা সংবিধান তিনি নিজেই চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে পরিবর্তন করেছেন। বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকা উচিৎ নয়, সেটি বঙ্গবন্ধুরই সিদ্ধান্ত। যার নেতৃত্বে দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, সেই জাতির পিতাই অভিজ্ঞতার আলোকে সংবিধান সংশোধন করেছেন। এরপর বিচারপতি অপসারণ পদ্ধতিটিই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়েছে’।
 
শুনানির এক পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘তৎকালীন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী এক ধরনের সুবিধা দিতেই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে বাদ দিয়ে পঞ্চদশ সংশোধনী করেছেন’।
 
এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘তিনি টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী ছিলেন। বারের (সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি) নির্বাচিত দু’বারের সভাপতি। তিনি অত্যন্ত সজ্জন ও ভদ্রলোক। তার মন্ত্রিত্বকালে বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে মধুর সুসম্পর্ক ছিল’।
 
প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টকে আন্ডারমাইন করবেন না। টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীদের নিয়ে এতো কথা বলছেন? তাহলে কেন এ প্রথা রেখেছেন, কেন বাতিল করেননি? একটি শব্দ ব্যবহারের আগে বুঝে-শুনে করবেন। ইট মারলে পাটকেল পড়বে, এটি মনে রাখবেন। যার কথা বলেছেন, তার যুদ্ধাপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনে অবদান রয়েছে। তাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই’।
 
জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টি রাজনৈতিক ম্যানিফেস্টোতে ছিল। এটি প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল। প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকাকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। তিনি না থাকলে এটি হতো না’।
 
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এখানে আবার প্রধানমন্ত্রীকে টানছেন কেন? আপনি যদি গণতন্ত্র, আইনের শাসনের কথা বলেন, তাহলে ইংল্যান্ডসহ বিশ্বের সভ্য দেশগুলোর দিকে তাকান। ভারতের বিচারক নিয়োগের কলেজিয়াম প্রথা বাতিল করে সরকার নতুন আইন করেছিল। সে আইন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটি নিয়ে সংসদের সদস্যরা কোনো টু শব্দ করেননি’।

‘পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন সে দেশের সুপ্রিম কোর্ট। সে দেশের সংসদ ও রাজনীতিবিদরা মাথা নিচু করে তা মেনে নিয়েছেন। যে পাকিস্তানে সুবিধাভোগী সরকার থেকেছে বেশিরভাগ সেময়, সেই দেশেই সুপ্রিম কোর্ট কি রকম ভূমিকা, তা দেখুন। কিন্তু আমাদের দেশে কি হয়, তা দেখুন’।

আপিল শুনানির প্রথম দু’দিনে গত ০৮ ও ০৯ মে প্রথম দু’দিনে হাইকোর্টের দেওয়া রায় পড়ে শোনান এবং ২১ ও ২২ মে পরের দু’দিনে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা। মঙ্গলবার (২৩ মে) থেকে দু’দিন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়।

সংবিধানের এ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ০৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের নয় আইনজীবী হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। এ রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে একই বছরের ০৯ নভেম্বর এ সংশোধনী কেন অবৈধ, বাতিল ও সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।

এ রুলের শুনানি শেষে গত বছরের ০৫ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেন বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ।

এর মধ্যে গত বছরের ২৫ এপ্রিল অসদাচারণের জন্য সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে তদন্ত ও তাকে অপসারণের প্রক্রিয়া নির্ধারণ করে ‘বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বিচারক (তদন্ত) আইন’ এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা।

গত ০৪ জানুয়ারি এ বিষয়ে আপিল করেন রাষ্ট্রপক্ষ।

১৯৭২ সালে প্রণীত মূল সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের কাছে ছিল। ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এ ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে অর্পণ করা হয়। পরে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হয় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে।

মার্শাল প্রক্লামেশনে করা পঞ্চম সংশোধনীতে এক্ষেত্রে ৯৬ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন আনা হয়েছিল। ষোড়শ সংশোধনীতে সেটা বাতিল করে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া হয় সংসদকে।

বাংলাদেশ সময়: ২০৪৫ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০১৭
ইএস/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।