ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

আদালত

রাজাকার হুসাইন-মোসলেমের ফাঁসি

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬১৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৯, ২০১৭
রাজাকার হুসাইন-মোসলেমের ফাঁসি

ঢাকা: মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে রাজাকার কমান্ডার সৈয়দ মো. হুসাইন ও মোহাম্মদ মোসলেম প্রধানকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

মুক্তিযুদ্ধে কিশোরগঞ্জের নিকলি থানা রাজাকার কমান্ডার হুসাইন ও ইউনিয়ন রাজাকার কমান্ডার মোসলেমের বিরুদ্ধে আনা হত্যা-গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, আটক, অপহরণ ও নির্যাতনের ছয়টি অভিযোগের সবগুলোই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে গণহত্যা ও ধর্ষণের দু’টি অপরাধে (৩ ও ৪ নম্বর অভিযোগ) সর্বোচ্চ সাজা দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।

৪ নম্বর অভিযোগে দু’জনই আর ৩ নম্বর অভিযোগে হুসাইন এককভাবে পেয়েছেন মৃত্যুদণ্ডাদেশ।    

এছাড়া শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মালেককে অপহরণ করে হত্যার দায়ে ৫ নম্বর অভিযোগে দু’জনই পেয়েছেন আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ।

হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, আটক, অপহরণ ও নির্যাতনের অন্য তিনটি অভিযোগই (১, ২, ৬ নম্বর) ছিল শুধু হুসাইনের বিরুদ্ধে। এসব অপরাধে আরও ২২ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে তাকে।

বুধবার (১৯ এপ্রিল) সকাল দশটা ৫০ মিনিট থেকে সোয়া ১২টা পর্যন্ত এ রায় দেন ট্রাইব্যুনাল।

চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হকের সূচনা বক্তব্যের পর বিচারিক প্যানেলের সদস্য বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম রায়ের প্রথম অংশ পড়েন। দ্বিতীয় অংশ পড়েন বিচারিক প্যানেলের অন্য সদস্য বিচারপতি মো. সোহরাওয়ারদী। সবশেষে রায়ের শেষ বা সাজার অংশ ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান।

সকাল সাড়ে নয়টার দিকে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে থাকা আসামি মোসলেম প্রধানকে ট্রাইব্যুনালে এনে হাজতখানায় রাখা হয়। পৌনে এগারটার দিকে তাকে তোলা হয় এজলাসকক্ষের আসামির কাঠগড়ায়। রায়ের পরে তাকে সাজা পরোয়ানা দিয়ে ফের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। প্রধান আসামি হুসাইন পলাতক।

যে অপরাধে যে সাজা
এ মামলার প্রধান আসামি হুসাইনের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাছিহাতায় হলেও মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কিশোরগঞ্জের হয়বতনগরে ছিলেন। মোসলেম কিশোরগঞ্জের নিকলি থানার বাসিন্দা। তাদের বিরুদ্ধে নিকলিতে যৌথ ও এককভাবে যুদ্ধাপরাধ সংঘটনের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে ট্রাইব্যুনালের রায়ে। মুক্তিযুদ্ধকালে ৬২ জনকে হত্যা-গণহত্যা, ৬ নারীকে গণধর্ষণ, ১১ জনকে অপহরণ, আটক ও নির্যাতন এবং দুইশ’ ৫০টি বাড়ি-ঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে তারা জড়িত ছিলেন বলেও প্রমাণিত হয়েছে।

এসব অপরাধে সব মিলিয়ে হুসাইন দু’বার মৃত্যুদণ্ড, একবার আমৃত্যু ও ২২ বছরের কারাদণ্ড এবং মোসলেম একবার করে মৃত্যুদণ্ড ও আমৃত্যু কারাদণ্ড পেয়েছেন। তবে যেহেতু সর্বোচ্চ সাজা হয়েছে, সেহেতু বাকি সাজার কার্যকারিতা থাকবে না।

এর মধ্যে তৃতীয় অভিযোগে দু’জনই এবং চতুর্থ অভিযোগে হুসাইনকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সর্বোচ্চ সাজা দিয়েছেন তিন বিচারপতি।    

তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, নিকলির গুরুই গ্রামের পূর্বপাড়ায় ১৯৭১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৭টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ফুল মিয়াসহ ২৬ জনকে হত্যা এবং ২৫০টি বাড়ি-ঘরে আগুন ধরিয়ে দেন হুসাইন-মোসলেমের নেতৃত্বে রাজাকাররা।

চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়েছে, নিকলির নানশ্রী গ্রামে ১৯৭১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হিন্দুদের আটকে রেখে নির্যাতনের পর ছয় নারীকে ধর্ষণ, সুধীর সূত্রধরসহ ৩৪ জনকে গুলি করে হত্যা ও বাদল বর্মণসহ চারজনকে নির্যাতন করেন হুসাইনের নেতৃত্বে রাজাকাররা।

দু’জনকেই ঐকমত্যের ভিত্তিতে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে পঞ্চম অভিযোগে।

পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়েছে, হুসাইন ও মোসলেম প্রধানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর নিকলি সদরের পূর্বগ্রামে মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুল মালেককে নিজ বাড়ি থেকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়।

১, ২ ও ৬ নম্বর অভিযোগে যথাক্রমে ৫ বছর, ৭ বছর ও ১০ বছরের কারাদণ্ড পেয়েছেন হুসাইন। এর মধ্যে প্রথমটিতে ঐকমত্য থাকলেও বাকি দু’টিতে সাজার রায় আসে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে।

প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, নিকলির দামপাড়া গ্রাম ও নিকলি থানা ভবন, সদরের মহাশশ্মান এলাকায় ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তোফাজ্জল খান জিতুসহ সাতজনকে  অপহরণসহ নির্যাতন চালানো হয় হুসাইনের নেতৃত্বে।

দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, নিকলি বাজার ও থানা কম্পাউন্ড এলাকায় হুসাইন ও মোসলেম প্রধানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত কাশেম আলীসহ চারজনকে আটক, অপহরণ ও নির্যাতন করা হয়।

ষষ্ঠ অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বর সন্ধ্যা সাতটা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা খায়রুল জাহান ও মো. সেলিমকে হত্যা করে তাদের মৃতদেহ কিশোরগঞ্জ পৌর সদর, প্যারাভাঙা ও শোলাকিয়ায় রিকশা দিয়ে ঘুরিয়েছিলেন হুসাইন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা খায়রুল জাহানের মাকে তার ছেলের রক্ত দেখিয়ে বীভৎসতা প্রর্দশন করেছিলেন তিনি।

গ্রেফতার থেকে সর্বোচ্চ সাজার রায়
২০১৫ সালের ০৭ জুলাই  বিরুদ্ধে রাজাকার কমান্ডার সৈয়দ মো. হুসাইন (৬৪) ও তার সহযোগী মোহাম্মদ মোসলেম প্রধানের (৬৬) বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল-২। এরপর নিকলি উপজেলার কামারহাটি গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে মোসলেমকে গ্রেফতার করা হয়।

এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) হরি দেবনাথ ২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর থেকে ২০১৫ সালের ০৭ অক্টোবর পর্যন্ত দীর্ঘ ১০ মাস ২৫ দিনে তদন্ত শেষ করে ওইদিন তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। প্রতিবেদনে দু’জনের বিরুদ্ধে মূল একশ’ ৬১ পৃষ্ঠার সঙ্গে সর্বমোট চারশ’ ৩৯ পৃষ্ঠার নথিপত্র রয়েছে।

পরদিন ০৮ অক্টোবর এ তদন্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনের কাছে জমা দেওয়া হলে এর ভিত্তিতে ০৩ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) তৈরি করে দাখিল করেন ট্রাইব্যুনালে।

গত বছরের ০৭ জানুয়ারি এ অভিযোগ আমলে নেন আদালত।

গত বছরের ২৬ এপ্রিল আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি (চার্জ হেয়ারিং) করেন প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ও প্রসিকিউটর তাপস কান্তি বল। আসামিদের পক্ষে শুনানি করেন আবদুস সাত্তার পালোয়ান।

গত বছরের ০৯ মে হুসাইন-মোসলেমের বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। ০৫ জুন রাষ্ট্রপক্ষের সূচনা বক্তব্য (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) উপস্থাপন শেষে সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।

দুই আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন ২০ জন সাক্ষী।

গত ০৭ মার্চ উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপনের মাধ্যমে  এ মামলায় বিচারিক কার্যক্রম শেষ হলে রায় যেকোনো দিন দেওয়া হবে জানিয়ে অপেক্ষমান (সিএভি) রাখেন ট্রাইব্যুনাল।

ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ। আসামিপক্ষে ছিলেন আইনজীবী আব্দুস সাত্তার পালোয়ান।

পলাতক সৈয়দ মো. হুসাইন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কিশোরগঞ্জের তাড়াইল থানার রাজাকার কমান্ডার পলাতক সৈয়দ মো. হাসান আলী ওরফে হাছেন আলীর ছোট ভাই। হাসান আলীকে ২০১৫ সালের ০৯ জুন ফাঁসি অথবা ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল-১। তার বিরুদ্ধে আনা ছয়টি মানবতাবিরোধী অভিযোগের মধ্যে পাঁচটিই প্রমাণিত হওয়ায় তাকে সর্বোচ্চ এ দণ্ড দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১২১৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৯, ২০১৭
ইএস/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।