ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

ইসলাম

ইসলামে জুয়া-বাজি সম্পূর্ণ হারাম

ইসলাম ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৫৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৯
ইসলামে জুয়া-বাজি সম্পূর্ণ হারাম

সম্প্রতি ‘ক্যাসিনো-তত্ত্ব’কে কেন্দ্র করে জুয়া শব্দটি নতুনভাবে আলোচিত হচ্ছে। বাংলাদেশে জুয়া-বাজি ইত্যাদি সরকার-কর্তৃক নিষিদ্ধ। সরকারের নিষেধাজ্ঞাকে অমান্য করে কিছু অসাধু ব্যক্তি জুয়ার আসর জমিয়ে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। বলা বাহুল্য, মদ-জুয়া জাতীয় সবকিছু সামাজিক, পারিবারিক, আর্থিক ও নৈতিক সঙ্কট তৈরি করে। মানুষকে বহুবিধ ক্ষতির সম্মুখীন করে।

জুয়ার ইতিহাস বেশ প্রাচীন
ইসলামপূর্ব জাহেলি যুগেও জুয়া খেলার প্রচলন ছিল। তখন লোকেরা জুয়া-বাজি ইত্যাদিতে ভীষণ অভ্যস্ত ছিল।

প্রায় সময় লোকেরা তাদের পরিবার ও সম্পদের ওপর বাজি ধরতো। হেরে গিয়ে চিন্তাক্লিষ্ট ও হতাশাগ্রস্ত হতো। সে দেখতো তার সম্পদ অন্যের হাতে। ফলে বিজয়ীর সঙ্গে বিরোধ, শত্রুতা ও ক্ষোভ-দ্বন্ধ শুরু হতো। (জাদুল মাসির, খণ্ড: ০২, পৃষ্ঠা: ৪১৮)

জুয়ার যে পদ্ধতি জাহেলি যুগে প্রসিদ্ধ ছিল
জাহেলি যুগে দশ জনে সমান অংক দিয়ে একটা উট ক্রয় করতো, সেই উটের গোশত ভাগ-বাটোয়ারার জন্য জুয়ার তীর ব্যবহার করা হতো। ১০টি তীরের ৭টিতে কম-বেশি করে বিভিন্ন অংশ লেখা থাকতো এবং তিনটিতে কোনো অংশই লেখা থাকত না (এক প্রকার লটারী)। ফলে তিনজন কোনো অংশ পেত না এবং অন্য সাত জন তাদের প্রচলিত নিয়মে কম-বেশি অংশ পেত। এভাবে তারা দশ জনের টাকায় কেনা উট সাত জনে ভাগ করে নিত। বাকি তিনজন শূন্য হাতে ফিরে যেতো। (মুহাররামাতুন ইস্তাহানা বিহান্নাস, পৃষ্ঠা: ৫২)

জুয়ার বিভিন্ন ধরন ও রকম
বর্তমানে জুয়া-বাজির জন্য বিভিন্ন রকমের আসর বসে বিভিন্ন দেশে। কোথাও হাউজি আবার কোথাও সবুজ টেবিল নামে পরিচিত। ফুটবল ও অন্যান্য খেলাধুলার প্রতিযোগিতায়ও বাজি ধরা হয়। প্রাচীন পদ্ধতি ছাড়াও জুয়ার আরও বহু নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার হয়েছে। যেমন- ফ্লাস, পাশা, বাজি রেখে ঘোড় দৌড়, তাস খেলা, চাক্কি ঘোরানো ও রিং নিক্ষেপ ইত্যাদি।

এগুলোর সবই হারাম। জুয়া হারাম হওয়ার ক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে,  শুধু নাম পরিবর্তনের কারণে বস্তু ও মূল প্রকৃতি এবং হুকুম পরিবর্তন হয় না। কাজেই প্রাচীনকালে প্রচলিত জুয়া সম্পর্কে যে হুকুম প্রযোজ্য ছিল, আধুনিককালের সব ধরনের জুয়ার ক্ষেত্রেও সেসব হুকুম সাব্যস্ত হবে।

‘ক্যাসিনো-সংস্কৃতি’ নতুন কিছু নয়
ক্যাসিনো ইতালিয়ান শব্দ। ক্যাসিনো বলতে বোঝায় যেখানে জুয়া, নাচ, গান ও বিভিন্ন খেলাধুলার সংমিশ্রণ থাকে। ১৬৩৮ সালে ইতালির ভেনিসে সর্বপ্রথম জুয়ার মাধ্যমে ক্যাসিনো ব্যবসা শুরু হয় বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানা গেছে।

জুয়া সম্পর্কে বাংলাদেশের আইন
বাংলাদেশে জুয়া-বাজি ইত্যাদি নিষিদ্ধ। ১৮৬৭ সালে প্রণীত বঙ্গীয় প্রকাশ্য জুয়া আইন দেশে এখনো প্রযোজ্য। আইন অনুযায়ী, কোনো ঘর-বাড়ি, স্থান বা তাঁবু জুয়ার আসর হিসেবে ব্যবহৃত হলে তার মালিক বা রক্ষণাবেক্ষণকারী, জুয়ার ব্যবস্থাপক বা এতে কোনো সাহায্যকারী তিন মাসের কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ২০০ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।

এধরনের কোনো ঘরে তাস-পাশা, কাউন্টার বা যেকোনো সরঞ্জামসহ কোনো ব্যক্তিকে ক্রীড়ারত (জুয়ারত) বা উপস্থিত দেখতে পাওয়া গেলে, তিনি এক মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা ১০০ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।

পুলিশ জুয়া-সামগ্রীর খোঁজে যেকোনো সময় (বলপ্রয়োগ করে হলেও) তল্লাশি চালাতে পারবেন বলেও আইনে উল্লেখ রয়েছে। (এছাড়াও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রহমানও রেসকোর্স ময়দানকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘোষণা করার সময়েই এ দেশে সব রকমের রেস জুয়া বন্ধের কথা বলেছিলেন। )

ইসলাম জুয়াকে যেভাবে দেখে
জুয়াকে আরবিতে ‘আল-কিমার’ ও আল-মায়সির’ বলা হয়। এমন খেলাকে ‘আল-কিমার’ ও আল-মায়সির’ বলা হয়, যা লাভ ও ক্ষতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে। অর্থাৎ যার মধ্যে লাভ বা ক্ষতি কোনোটাই স্পষ্ট নয়। ইসলামের আবির্ভাবের আগে ও নবী করিম (সা.)-এর আগমনের সময় তৎকালীন মক্কায় নানা ধরনের জুয়ার প্রচলন ছিল। তিনি সবগুলোকে নিষিদ্ধ করেছেন।

ইসলামে জুয়া-বাজি ইত্যাদি স্পষ্ট হারাম
জুয়া সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্ট বর্ণনা এসেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণায়ক শর ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা বর্জন করো, তাহলেই তোমরা সফলকাম হতে পারবে। শয়তান তো মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে চায় এবং তোমাদের আল্লাহর স্মরণ ও নামাজ আদায়ে বাধা দিতে চায়। তবে কি তোমরা নিবৃত্ত হবে না। ’ (সুরা মায়িদা, আয়াত: ৯০-৯১)

কোরআনে মদ ও জুয়াকে ঘৃণ্য বস্তু এবং শয়তানের কাজ বলা হয়েছে। এগুলো থেকে দূরে থাকার আদেশ দেওয়া হয়েছে। মদ-জুয়ার মাধ্যমে পরস্পর শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়। উপরন্তু এগুলোর মাধ্যমে শয়তান মানুষকে নামাজ ও আল্লাহতায়ালার স্মরণ থেকে বিমুখ রাখে। মদ-জুয়া হারাম হওয়ার বিষয়টি অস্বীকারের কোনো সুযোগ নেই।

জুয়া সম্পর্কে হাদিসে যা বলা হয়েছে
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা মদ, জুয়া ও বাদ্যযন্ত্র হারাম করেছেন। ’ (বায়হাকি, হাদিস: ৪৫০৩; মিশকাত, হাদিস: ৪৩০৪)

আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, জুয়ায় অংশগ্রহণকারী, খোঁটাদাতা ও মদ্যপায়ী জান্নাতে যাবে না। ’ (দারেমি, হাদিস: ৩৬৫৩; মিশকাত, হাদিস: ৩৪৮৬)

আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ লাত-উজ্জার শপথ ইত্যাদি বললে, তবে সে যেন সঙ্গে সঙ্গে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলে। আর কেউ যদি অন্যকে প্রস্তাব দেয়, এসো আমরা জুয়া খেলি; সে যেন (জরিমানাস্বরুপ) দান-সদকা করে। (বুখারি, হাদিস: ৪৮৬০; মুসলিম, হাদিস: ১৬৪৭; তিরমিজি, হাদিস: ১৫৪৫; ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২০৯৬)

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, নবী (সা.) যখন (মক্কা) এলেন, তখন কাবাঘরে প্রবেশ করতে অস্বীকৃতি জানান। কেননা কাবা ঘরের ভেতরে মূর্তি ছিল। তিনি নির্দেশ দিলে মূর্তিগুলো বের করে ফেলা হয়। (এক পর্যায়ে) ইবরাহিম ও ইসমাইল (আ.)-এর প্রতিকৃতি বের করে আনা হয়। উভয় প্রতিকৃতির হাতে জুয়া খেলার তীর ছিল। তখন নবী (সা.) বললেন,  আল্লাহ! ধ্বংস করুন। আল্লাহর কসম! অবশ্যই তারা জানে যে, [ইবরাহিম ও ইসমাইল (আ.)] তীর দিয়ে অংশ নির্ধারণের ভাগ্য পরীক্ষা কখনো করেননি। এরপর নবী (সা.) কাবাঘরে প্রবেশ করেন এবং ঘরের চারদিকে তাকবির বলেন। তবে ঘরের ভেতরে সালাত আদায় করেননি। (বুখারি, হাদিস: ১৫০৩)

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, ‘বলা হতো, উটের জুয়াড়িরা কোথায়? তখন দশজন প্রতিযোগী একত্রিত হতো এবং জুয়ার উটটির ক্রয়মূল্য হিসেবে দশটি উটশাবক নিৰ্দ্ধারণ করতো। তারা জুয়ার পাত্রে তীর স্থাপন করে সেটিকে চক্কর দেয়াতো, তাতে একজন বাদ পড়ে নয়জন অবশিষ্ট থাকতো। এভাবে প্রতি চক্করে একজন করে বাদ পড়ে শেষে মাত্র একজন অবশিষ্ট থাকতো এবং সে বিজয়ী হিসেবে তার শাবকসহ অন্যদের নয়টি শাবকও লাভ করতো। এতে নয়জনের প্রত্যেকে একটি করে শাবক লোকসান দিতো। এটাও এক প্রকার জুয়া। ’ (আদাবুল মুফরাদ, হাদিস নম্বর: ১২৭১)

আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, ‘তীর নিক্ষেপে বাজিধরা জুয়ার অন্তর্ভুক্ত। ’ (ফাতহুল কাদির, হাদিস: ১২৭২)

ফুদাইল ইবনে মুসলিম (রহ.) তার পিতার সূত্রে বর্ণনা করেন, ‘আলী (রা.) বাবুল কাসর থেকে বের হলে তিনি দাবা-পাশা খেলোয়াড়দের দেখতে পান। তিনি তাদের কাছে গিয়ে তাদের ভোর থেকে রাত পর্যন্ত আটক রাখেন। তাদের মধ্যে কতককে তিনি দুপুর পর্যন্ত আটক রাখেন। (বর্ণনাকারী বলেন, যারা অর্থের আদান-প্রদানের ভিত্তিতে খেলেছিল, তিনি তাদের রাত পর্যন্ত আটক রাখেন, আর যারা এমনি খেলেছিল তাদেরকে দুপুর পর্যন্ত আটক রাখেন। ) তিনি নির্দেশ দিতেন, লোকজন যেন তাদের সালাম না দেয়। ’ (আদাবুল মুফরাদ, হাদিস: ১২৮০)

জুয়া-বাজি থেকে প্রাপ্ত সবকিছু হারাম
সব ধরনের জুয়া-বাজি ইসলামে অবৈধ। জুয়া-বাজি থেকে প্রাপ্ত সবকিছু হারাম। হারাম ভোগ করে ইবাদত-বন্দেগি করলে, আল্লাহ তাআলা তা কবুল করেন না। তাই মুসলমান হিসেবে সব ধরনের জুয়া-বাজি থেকে দূরে থাকা আবশ্যক।

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, প্রত্যন্ত গ্রামেও বসছে জুয়ার আসর। কৃষক, তরুণ, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থীরা জড়িয়ে পড়ছেন মরণনেশা জুয়ায়। এসব আসরে উড়ছে লাখ লাখ টাকা। মাদকের মতোই জুয়ার গ্রাস এখন দৃশ্যমান। এমতাবস্থায় অনৈতিক এসব কর্মকাণ্ড বন্ধে প্রশাসনের ব্যবস্থা নেওয়াকে সাধুবাদ জানাতে হয়।

ইসলাম বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। লেখা ও প্রশ্ন পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৯
এমএমইউ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।