ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

ইসলাম

থাইল্যান্ডে ইসলাম ও ইসলামী শিক্ষা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৩৭ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০১৮
থাইল্যান্ডে ইসলাম ও ইসলামী শিক্ষা ছবি: সংগৃহীত

পিএইচডির জন্য বেশ কয়েক বছর মালয়েশিয়া অবস্থানকালে প্রতিবেশী থাইল্যান্ডে ভ্রমণ কিংবা কোনো প্রোগ্রামে যাওয়ার তীব্র ইচ্ছা থাকলেও যাওয়া হয়নি। কিন্তু হঠাৎ করেই সুযোগটা চলে আসে হাতের মুঠোয়। 

থাইল্যান্ডের ইয়ালা রাজাবাহাত বিশ্ববিদ্যালয় একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে। সেখানে আমার একটা গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপনের জন্য পাঠালেও আমার সিভি (জীবনবৃত্তান্ত) দেখে কর্তৃপক্ষ আমাকে কিনোট স্পিকার এবং আন্তর্জাতিক প্যানেল ডিসকাসেন্ট হিসেবে আমন্ত্রণ করে।

ফলে প্রবন্ধ উপস্থাপনের জন্য যাতায়াত, থাকা-খাওয়াসহ সবরকম আয়োজন করে দেয় কর্তৃপক্ষ, যা রীতিমত আমাকে অবাক করে। সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টা আমাকে অবাক করেছে, তা হলো তাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ও সামাজিক জীবনে ইসলাম এবং এর অনুশীলন দেখে।  

মোট জনসংখ্যার মাত্র ২ শতাংশ মুসলিম। দেশটির তিনটি প্রদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে বিবেচিত। এগুলোরমধ্যে অন্যতম ‘ইয়ালা’। সেখানকার মোট জনগোষ্ঠীর ৭৫ শতাংশ মুসলিম। এখানকারই একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ‘ইয়ালা রাজাবাহাত বিশ্ববিদ্যালয়’। সেখানে যাওয়ার উদ্দেশ্যে যখন আমি ব্যাংকক থেকে ডমেস্টিক ফ্লাইটে হাটইয়াই বিমানবন্দরে পৌঁছাই, তখন আমাকে নেওয়ার জন্য সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক এবং একজন ছাত্রকে বিমানবন্দরে অপেক্ষারত অবস্থায় দেখতে পাই।  

তাদের সঙ্গে পরিচয়ের সময় লক্ষ্য করি, শিক্ষকটি আমার সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বললেও ছাত্রটি কথা বলছেন আরবিতে। আমি মনে করলাম, হয়ত সে ইসলামিক স্টাডিজ কিংবা আরবি বিভাগে পড়ে।  

সে কোন প্রোগ্রামে এবং কোন বিভাগে অধ্যয়ন করছে তা জানতে চাইলে তিনি জানান, এডুকেশন ডিপার্টমেন্টে মাস্টার্সে।  

তিনি কিভাবে আরবি শিখেছেন তা অবাক হয়ে জানতে চাইলাম। আমি যেমন অবাক হয়েছিলাম, তারচেয়ে বোধহয় তারা দুইজনই বেশি অবাক হলেন আমার প্রশ্ন শুনে।  

এরপর সেই শিক্ষক আমাকে জানালেন, থাইল্যান্ডের এ অঞ্চলের সব মুসলিম ছাত্ররাই ইংরেজিতে ভাল কথা বলতে পারবেন না এটা ঠিক কিন্তু আরবিতে মোটামুটি কথাবার্তা চালাতে পারবেন। কারণ, তাদের শিক্ষা জীবনের শুরুতেই আরবিটাকে খুবই গুরুত্ব দিয়ে শেখানো হয়। কেবল কোরআন তেলাওয়াত বা হাদিস পড়তে পারাটাই তাদেরকে সন্তুষ্ট করতে পারে না, বরং এটি তাদের জন্য সেকেন্ড ল্যাংগুয়েজ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। আর তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত প্রায় প্রত্যেক মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীই আরবিতে কথা বলতে পারে।  

বিষয়টা জানার পর থেকেই মনের মধ্যে কেমন যেন খচখচ করতে লাগল। আমাদের বহনকারী গাড়িটি তখন নীল সমুদ্রের তীর ঘেঁষে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার বেগে এগিয়ে চললেও ক্ষণিকের জন্য লাল-সবুজে মোড়ানো ৯২ শতাংশ মুসলিমের কথা মনে পড়ে আমার পৃথিবীটা যেন স্থির হয়ে গেল। আমাদের মাদ্রাসায় পড়ুয়ারাও যেখানে কুরআন শুদ্ধ করে পড়তে পারে না, সেখানে অন্যদের কথা কিই বা বলব!

আমার জন্যে যে আরও চমক অপেক্ষা করছিল তা কে জানতো! থাইল্যান্ডে ঘুরতে যাওয়াটা অনেকের কাছে সামাজিকভাবে তেমন গর্বের না। কারণ, দেশটির কিছু বিশেষ সংস্কৃতি। তাই, থাইল্যান্ড যাচ্ছি শুনে অনেকেই যেমন নাক সিঁটকান, তেমনি বিশেষ কিছু পরামর্শও দেন। এমন একটা দেশে ইসলাম ও ইসলামি শিক্ষাকে দেখে আমাকে এতটা অবাক করবে ভাবিনি কখনও।
 
যাই হোক, যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার প্রোগ্রাম সেখানে মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা শতকরা ৭৫ ভাগ। তবে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হওয়াতে উচ্চপদস্থ প্রায় সব কর্মকর্তাই অমুসলিম। তবুও তাদের কনফারেন্স হলে প্রবেশ করেই অবাক হয়ে যাই। সেখানে একজন মুসলিম ছাত্রী কিংবা শিক্ষককে দেখলাম না যে পরেননি। এমন পরিস্থিতি দেখব তা চিন্তাও করিনি।  

প্রো-ভাইস চ্যান্সেলরকে সেখানে ভাইস প্রেসিডেন্ট বলা হয়। তিনি ছিলেন এ প্রোগ্রামে প্রধান অতিথি। সঙ্গে আরও কতিপয় অমুসলিম কর্মকতাও ছিলেন। তাদের উপস্থিতিতে প্রোগ্রাম শুরু হয় হামদ্ ও নাতের সঙ্গে। প্রায় ৩০ মিনিট যারা এই অনুষ্ঠানে পারফরমেন্স করলেন তাদের সবারই পরিধানে ছিল ইসলামি পোশাক। বাজনা ব্যবহার করলেও হাদিসে বর্ণিত ‘দফ’ই দেখলাম এখানে। এটাকেই তারা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করেন।  

পরবর্তী দিন ছিল শুক্রবার। এটি রমজানের পূর্বে শাবানের শেষ জুম্মাবার। কর্তৃপক্ষ আমাকে অনুরোধ করলেন, তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল মসজিদে খুতবা ও জুম্মার সালাত আদায় করার জন্যে। একটু শংকাবোধ থাকলেও তাদের বিশেষ অনুরোধকে উপেক্ষা করতে পারিনি।  

মসজিদটি খুব একটা বড় নয়। দুইতলা মসজিদে সবমিলিয়ে পাঁচ-ছয়শ মুসুল্লি সালাত আদায় করতে পারেন। আমাকে যখন সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়, আমি চারপাশে তাকিয়ে দেখি মসজিদের তিন দিকের পুরোটাই বিভিন্ন বইয়ের শেলফে ঘেরা। একটু কাছে যেয়ে দেখলাম, কুরআন ও হাদিসের গ্রন্থের পাশাপাশি রাসূল (সা.)-এর সিরাত, ফিকহ্ মাসলা-মাসায়েলের বইসহ ইসলামের ওপর বিভিন্ন বই। মসজিদটি দেখে ছোটখাট একটা লাইব্রেরিই মনে হলো।  

একবার আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা মনে হলো, সেখানে একখানা কুরআনই থাকে শেলফে। যাই হোক, একটু আগেভাগে যাওয়ার কারণে দেখতে থাকলাম যারাই মসজিদে ঢুকছেন, তারা দুই রাকাত সালাত আদায়ের পর কেউ কোরআন, কেউ হাদিস নিয়ে অধ্যয়ন করছেন।  

পরে তাদের জিজ্ঞেস করলাম, ইসলামী শিক্ষা নামে কোনো বিভাগ তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে কিনা? আমাকে আবারও অবাক করে তারা জানান, এই ইয়ালাতেই নাকি একটা পূর্ণাঙ্গ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় আছে যার নাম পাটানি বিশ্ববিদ্যালয়।  

সেই রাতেই আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো বিশ্ববিদ্যালয়টি দেখতে। গেট থেকে শুরু করে প্রত্যেকটা স্থাপত্যে ইসলামের একটা প্রভাব সুস্পষ্ট। এখানে শুধু কোরআন, হাদিস, ফিকহ, আরবি পড়ানো হয় না, বরং প্রত্যেকটা বিষয়ই ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পড়ানো হয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি তাদের আরও একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হলো, প্রিন্স সংখলা ইউনিভার্সিটি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ক্যাম্পাস আছে পাত্তানি প্রভিন্সে। সেখানে আরবি, ইসলামি স্টাডিজসহ, ইসলামি ল, ইসলামি এডুকেশন নামে বিভাগ রয়েছে।  

এছাড়া আরও অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা তারা বলল যেখানে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ শুধু নয়, ইসলামি আইন, ইসলামি এডুকেশন অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে পড়ানো হয়। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে অমুসলিম ছাত্ররা আরবি শেখে। তাছাড়া মুসলিম প্রধান এলাকায় সরকারি ও বেসরকারি মাদ্রাসার পাশাপাশি স্কুল কলেজেও ইসলামি শিক্ষাকে গুরুত্বের দেখা হয়। এসব এলাকার অনেকেই আল-আজহার, উম্মুল কুরা, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় মদিনা, আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের নামকরা সব প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ফিরে এসে নিজ এলাকায় ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতি, ইসলামি অনুশাসন ও তা চর্চার জন্য মানুষের মাঝে কাজ করে যাচ্ছে।  

এরকম শিক্ষাব্যবস্থার জন্য মানুষগুলোকে যেভাবে গড়ে তোলা হয়েছে তাই ছিল ইসলামের কাম্য। তাদের এ অনুশাসন শুধু অমুসলিম দেশের জন্য নয় বরং মুসলিম দেশসমূহের জন্যও অনুকরণীয় বলে আমার বিশ্বাস।  

লেখক: শিক্ষাবিদ ও গবেষক

বাংলাদেশ সময়: ১৫৩০ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০১৮
এনএইচটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।