ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

জীবনযাপন

সুরা কাউসার: দোজাহানের অফুরন্ত কল্যাণের সুখবর

ইসলাম ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২৩ ঘণ্টা, মে ১৯, ২০১৮
সুরা কাউসার: দোজাহানের অফুরন্ত কল্যাণের সুখবর সুরা কাউসার: দোজাহানের অফুরন্ত কল্যাণের সুখবর

সুরা কাওসার
মক্কায় অবতীর্ণ: আয়াত ৩

পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু 
(১)    নিশ্চয় আমি আপনাকে কাউসার দান করেছি।
(২)    অতএব আপনার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন এবং কোরবাবি করুন।


(৩)    যে আপনার শত্রু, সে-ই তো লেজকাটা, নির্বংশ।

শানে নুযুল
মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনে হোসাইন থেকে বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তির পুত্রসন্তান মারা যায়, আরবে তাকে  নির্বংশ বলা হয়। রাসুলুল্লাহ্ (সা.) এর পুত্র কাসেম অথবা ইবরাহীম যখন শৈশবেই মারা গেলেন, তখন কাফেররা তাকে নির্বংশ বলে উপহাস করতে লাগলো। ওদের মধ্যে ‘আস ইবনে ওয়ায়েল’র নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার সামনে রাসুলুল্লাহ্ (সা.) এর কোনও আলোচনা হলে সে বলত, আরে তার কথা বাদ দাও, সে তো কোনও চিন্তারই বিষয় নয়। কারণ, সে নির্বংশ। তার মৃত্যু হয়ে গেলে তার নাম উচ্চারণ করারও কেউ থাকবে না। এর পরিপ্রেক্ষিতে সূরা কাউসার অবতীর্ণ হয় ইবনে। (ইবনে কাসির, মাযহারি)।

সারকথা
পুত্রসন্তান না থাকার কারণে কাফেররা রাসুলুল্লাহ (সা.) এর প্রতি দোষারোপ করতো অথবা অন্য কারণে তার প্রতি ধৃষ্টতা প্রদর্শন করতো। এরই প্রেক্ষাপটে সুরা কাউসার অবতীর্ণ হয়। এতে দোষারোপের জওয়াব দেওয়া হয়েছে যে, শুধু পুত্রসন্তান না থাকার কারণে যারা রাসুলুল্লাহ্ (সা.)-কে নির্বংশ বলে, তারা তার প্রকৃত মর্যাদা সম্পর্কে বে-খবর। রাসুলুল্লাহ্ (সা.) এর বংশগত সন্তান-সন্ততিও কেয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে, যদিও তা কন্যা-সন্তানের তরফ থেকে হয়। নবীর আধ্যাত্মিক সন্তান অর্থাৎ, উম্মত তো এত অধিকসংখ্যক হবে যে, পূর্ববর্তী সব নবীর উম্মতের সমষ্টি অপেক্ষাও বেশি হবে। এছাড়া এ সুরায় রাসুলুল্লাহ্ (সা.) যে আল্লাহ্ তায়ালার কাছে প্রিয় ও সম্মানিত তাও তৃতীয় আয়াতে বিবৃত হয়েছে।

হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘কাউসার’ সেই অজস্র কল্যাণ যা আল্লাহ্ তায়ালা রাসুলুল্লাহ্ (সা.)-কে দান করেছেন। কাউসার জান্নাতের একটি প্রস্রবণের নাম। এই উক্তি সম্পর্কে সায়ীদ ইবনে জুবায়ের (রহ.)-কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বললেন, একথা ইবনে আব্বাস (রা.)-এর উক্তির পরিপন্থী নয়। কাউসার নামক প্রস্রবণটিও এই অজস্র কল্যাণের একটি। তাই কাউসারের তফসির প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, এটা উভয় জাহানের অফুরন্ত কল্যাণ। এতে জান্নাতের বিশেষ কাউসার প্রস্রবণও অন্তর্ভুক্ত।

হাউযে কাউসার
হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, একদিন রাসুলুল্লাহ্ (সা.) মসজিদে আমাদের সামনে উপস্থিত হলেন। হঠাৎ তার মধ্যে তন্দ্রা অথবা একপ্রকার অচেতনতার ভাব দেখা দিল। অতঃপর তিনি হাসিমুখে মস্তক উত্তোলন করলেন। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ্, আপনার হাসির কারণ কী?’ তিনি বললেন, ‘এই মুহূর্তে আমার নিকট একটি সুরা অবতীর্ণ হয়েছে’। অতঃপর তিনি বিসমিল্লাহ্সহ সুরা কাউসার পাঠ করলেন এবং বললেন, ‘তোমরা জান, কাউসার কী?’ আমরা বললাম, ‘আল্লাহ্ তায়ালা ও তার রাসুলই ভাল জানেন’। তিনি বললেন, ‘এটা জান্নাতের একটি নহর। আমার পালনকর্তা আমাকে এটা দেবেন বলে ওয়াদা করেছেন। এতে অজস্র কল্যাণ আছে এবং এই হাউযে কেয়ামতের দিন আমার উম্মত পানি পান করতে যাবে। এর পানি পান করার পাত্র সংখ্যা আকাশের তারকাসম হবে। তখন কতক লোককে ফেরেশতাগণ হাউয থেকে হটিয়ে দেবে। আমি বলবো, পরওয়ারদেগার, সে তো আমার উম্মত। আল্লাহ তায়ালা বলবেন, আপনি জানেন না, আপনার পরে সে কি নতুন মত ও পথ অবলম্বন করেছিল?’ (বোখারি, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসায়ী)

ফাসাল্লি লি রাব্বিকা ওয়ানহার
এর অর্থ উট কোরবানি করা। এর প্রচলিত পদ্ধতি হচ্ছে হাত-পা বেঁধে কণ্ঠনালীতে বর্শা অথবা ছুরি দিয়ে আঘাত করা এবং রক্ত বের করে দেওয়া। গরু-ছাগল ইত্যাদির কোরবানি। অর্থাৎ, জন্তুকে শুইয়ে কণ্ঠনালীতে ছুরিকাঘাত করা। আরবে সাধারণতঃ উট কোরবানি করা হত। তাই কোরবানি বোঝাবার জন্যে এখানে নহর শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। মাঝে মাঝে এ শব্দটি যে কোনও কোরবানির অর্থেও ব্যবহৃত হয়। সুরার প্রথম আয়াতে কাফেরদের মিথ্যা ধারণার বিপরীতে রাসুলুল্লাহ্ (সা.)-কে কাউসারর সুসংবাদ শুনানোর পর এর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তাকে দু’টি বিষয়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, নামায ও কোরবানি। নামায শারীরিক এবাদতসমূহের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ এবাদত এবং কোরবানি আর্থিক এবাদতসমূহের মধ্যে বিশেষ স্বাতন্ত্র ও গুরুত্বের অধিকারী। কেননা, আল্লাহ্ তায়ালার নামে কোরবানি করা প্রতিমা পূজারীদের রীতি-নীতির বিরুদ্ধে একটি জেহাদ বটে। তারা প্রতিমাদের নামে কোরবানি করত। এ কারণেই অন্য এক আয়াতেও নামাযের সঙ্গে কোরবানির উল্লেখ আছে। আলোচ্য আয়াতে এর অর্থ যে কোরবানি, এ কথা হযরত ইবনে আব্বাস (রা.), আতা, মুজাহিদ, হাসান বসরী (রহ.) প্রমুখ থেকে বর্ণিত আছে।

ইন্না শা’নিয়াকা হুওয়াল আবতার
এর অর্থ শত্রুতাপোষণকারী, দোষারোপকারী। যেসব কাফের রাসুলুল্লাহ্ (সা.)-কে নির্বংশ বলে দোষারোপ করত, এ আয়াত তাদের সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। আয়াতে অধিকাংশ রেওয়ায়েত মতে, ‘আস ইবনে ওয়ায়েল, কোনও কোনও রেওয়ায়েত মতে ওকবা এবং কোনও কোনও রেওয়ায়েত মতে, কা’ব ইবনে আশরাফকে বোঝানো হয়েছে। আল্লাহ্ তায়ালা রাসুলুল্লাহ্ (সা.)-কে কাউসার অর্থাৎ অজস্র কল্যাণ দান করেছেন। এর মধ্যে সন্তান-সন্ততির প্রাচুর্যও অন্তর্ভুক্ত। তার বংশগত সন্তান-সন্ততিও কম নয়। এছাড়া পয়গম্বর উম্মতের পিতা এবং উম্মত তার আধ্যাত্মিক সন্তান। রাসুলুল্লাহ্ (সা.)-এর উম্মত পূর্ববর্তী সকল পয়গম্বরের উম্মত অপেক্ষা অধিক হবে। সুতরাং একদিকে শত্রুদের উক্তি নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে এবং অপরদিকে আরও বলা হয়েছে যে, যারা আপনাকে নির্বংশ বলে প্রকৃতপক্ষে তারাই নির্বংশ।

{{তাফসিরে মাআরেফুল কোরআন 
হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শাফী’ (রহ.)}}

সম্পাদনায়
মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী
বিশিষ্ট মুফাস্সিরে কুরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব
চেয়ারম্যান: বাংলাদেশ মুফাস্সির সোসাইটি

www.selimazadi.com

বাংলাদেশ সময়: ১৮০৮ ঘণ্টা, মে ১৮, ২০১৮
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।