ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

অপার মহিমার রমজান

রহমত প্রাপ্তির এ মাস যেন বৃথা না যায়

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩২৪ ঘণ্টা, মে ১৮, ২০১৮
রহমত প্রাপ্তির এ মাস যেন বৃথা না যায় আজ প্রথম রমজান।

ফিরে এলো মাহে রমজান। আজ প্রথম রমজান। বান্দার ইবাদতের বসন্তকাল শুরু হলো আজ। আজ থেকে মাবুদের অফুরান রহমতের বারিধারায় পলি পড়বে রোজাদারের রূহে। বরকতের জোয়ার লেগে ফুল-ফল ফুটতে থাকবে মনের জমিনে। নাজাতের সওগাত বিতরণ হবে আজ থেকে সারা জাহানে।

আসে নৈতিক ও চারিত্রিক উন্নয়ন, সামাজিক শিষ্টাচার, পারস্পরিক সহনশীলতা, সাম্য, মৈত্রী ও শান্তির প্রতিশ্রুতি নিয়ে। তাকওয়া-খোদাভীতি, ধৈর্য, ত্যাগ, সাধনা, দয়া, দানশীলতা ও মানবপ্রেমের মতো নৈতিক গুণাবলীর বিকাশ হয় এই মাসে।

একমাত্র নৈতিক ও চারিত্রিক গুণাবলীর কারণেই মানুষ সৃষ্টির সেরা ‘আশরাফুল মাখলুকাত’। মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাতের সর্বোচ্চ মর্যাদায় পৌঁছে দিতেই প্রতিবছর আসে মাহে রমজান।

রমজান মানুষের জীবনে কীভাবে নৈতিক চরিত্রের বিকাশ সাধন করে সে প্রসঙ্গ টেনে শুরু করেছি প্রথম রমজানের আলোচনা।

সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য যাবতীয় পানাহার ও স্ত্রী-সংশ্রব থেকে বিরত থাকার নাম সিয়াম। এ সময় ক্ষুধা-পিপাসার অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করে রোজাদার আল্লাহর ভয়ে পানাহার থেকে বিরত থাকে। প্রাণপ্রিয় স্ত্রী থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় শুধু আল্লাহর ভয়ে। এভাবে কাম, ক্রোধ, লোভ ও নানা রকম দূষণীয় স্বভাব- যেগুলো মানুষকে নিয়ে যায় পশুর স্তরে , যেগুলো জন্ম দেয় সমাজে নানা অশান্তি ও অনাচার। এসবের সঙ্গে রোজাদারের সংগ্রাম চলে পুরো মাসব্যাপী। এই এক মাসের কৃচ্ছসাধনা ও নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের মাধ্যমে মানুষ নিজের নফস বা প্রবৃত্তিকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। দেহ পরিচালিত হয় নৈতিক চরিত্র ও বিবেকের নির্দেশ মত। এভাবেই মানবদেহের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় বিবেকের শাসন ও আল্লাহর রাজত্ব। ফলে মাটির মানুষ পরিণত হয় সোনার মানুষে।

সারাদিন উপবাসে কাতর হয়ে রোজাদার যখন ইফতারের সময় খাবার সামনে নিয়ে বসে, তা একাকি নিজে খেয়ে উদরপূর্তি করতে পারে না। রাসূল (সা.) এর পবিত্র বাণী বেজে উঠে তার হৃদয়তারে, ‘যে ব্যক্তি কোনও রোজাদারকে ইফতার করাবে, সে ব্যক্তির গোনাহের ক্ষমা ও দোজখ থেকে মুক্তি লাভের সম্বল হবে ইফতার এবং তাকে ওই রোজাদারের রোজার সমতুল্য অতিরিক্ত সওয়াব দেওয়া হবে। ’ (বায়হাকির বরাতে মিশকাত। )

যারা সমাজের ওপর তলার বাসিন্দা তারাও রমজানে উপোস থেকে উপলব্ধি করতে পারবেন অনাহার-উপবাসের কী ভয়াল যন্ত্রণা। তাই তারা নিজের সঞ্চিত অর্থের একটি অংশ জাকাত হিসাবে বিতরণ করেন গরিবদের মাঝে। রমজান শেষ হতেই তারা ফিতরা দিয়ে দেন অভাবী লোকদের হাতে। আর সে জাকাত-ফিতরায় গরিবদের সংসারে ফিরে আসে সচ্ছলতা। ধনীর ধনের প্রতি হিংসা আক্রোশের পরিবর্তে গরিবদের মনে জাগ্রত হয় শ্রদ্ধা ও সহযোগিতার ভাবধারা। আল্লাহর জন্য দান করে ধনীরাও পায় অনাবিল তৃপ্তি ও কল্যাণ। এমনি করে মাহে রমজানে ধনী ও গরিবের মাঝে মমত্ব, ভ্রাতৃত্ব ও সহযোগিতা প্রতিষ্ঠার অনুশীলন হয়। বিকশিত হয় অশরাফুল মাখলুকাতের অনন্য রূপসৌন্দর্য।

সন্ধ্যায় ইফতারের পর ক্লান্ত-অবসন্ন শরীর যখন বিছানায় মিশে যেতে চায় তখনই তাগাদা আসে তারাবিহ নামাজের। যুবক, বৃদ্ধ, কিশোর মিলে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তারাবিহ নামাজ আদায় করে মসজিদগুলোতে। তারাবিহর পর বিশ্রামের জন্য যেতে না যেতে আবার শেষ রাতে সেহরি খাওয়ার ডাক পড়ে।

রমজানে এমন কর্মব্যস্ততা আর তৎপরতা মানুষের যাবতীয় অলসতা-বিলাসিতা দূর করে তাকে সতেজ করে দেয়। এ মাস নিত্য-নতুন কর্মচাঞ্চল্য ও কর্ম ব্যস্ততায় উজ্জীবিত করে রোজাদারকে। প্রত্যেকের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয় সুষ্ঠু নিয়ম শৃঙ্খলা ও গতিশীলতা।

রমজান হচ্ছে মুসলমানদের আত্মশুদ্ধি, আত্মগঠন এবং সামাজিক উন্নতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠার মাসব্যাপী এক কর্মশালা। এই কর্মশালা রোজাদারের মনে জাগিয়ে দেয় আল্লাহর ভয় ও আখেরাতে আল্লাহর অফুরান প্রতিদান লাভের ইচ্ছে। এজন্য রোজার প্রধান শর্ত হচ্ছে, পানাহার ও স্ত্রী-সংশ্রব ত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর ইবাদত ও সওয়াবের নিয়ত করা।

নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসে ঈমান ও এহতেসাব (আত্ম-বিশ্লেষণ) সহকারে রোজা রাখে তার পূর্ববর্তী সব গোনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। ’ (বুখারি শরিফ)

এমনিভাবে রোজা সম্পর্কে হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ্ পাক বলেন, ‘রোজা একমাত্র আমার জন্য এবং তার প্রতিদান আমি নিজ হাতে দেবো, অথবা অন্য অর্থে আমিই স্বয়ং তার প্রতিদান। ’ (বুখারি, মুসলিমের বরাতে মিশকাত)

দুনিয়ার সব অশান্তির মূল আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাস ও আখেরাতের প্রতি উদাসিনতা। রমজান মনে জাগিয়ে দেয় আল্লাহর ভয়, আত্ম-উপলব্ধি ও পরকালে জবাবদিহির তীব্র অনুভূতি। ফলে কোনও বিশেষ ফোর্স বা দুর্নীতি দমন বিভাগের প্রয়োজন হয় না রোজাদারকে শাসন করার জন্য। রোজাদার আল্লাহর ভয়ে নিজে নিজেই সংযত হয়ে যায়। আদর্শ নাগরিক, সোনার মানুষ, আল্লাহর প্রতিনিধি প্রভৃতি যে কোনও উপাধিই প্রযোজ্য হয় রোজাদারের জন্য। আল্লাহ আমাদের মাসব্যাপী সাধনায় একনিষ্ঠ সাধক বানিয়ে দিন।

লেখক

বিশিষ্ট মুফাস্সিরে কুরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব

চেয়ারম্যান: বাংলাদেশ মুফাস্সির সোসাইটি

www.selimazadi.com

বাংলাদেশ সময়: ০৯২২ ঘণ্টা, মে ১৮, ২০১৮
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।