ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

আন্তর্জাতিক

একমাসে গণহত্যা-গণধর্ষণ-অগ্নিসংযোগ সবই করলো মিয়ানমার

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০১৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৭
একমাসে গণহত্যা-গণধর্ষণ-অগ্নিসংযোগ সবই করলো মিয়ানমার পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শিশু, ছবি: বাংলানিউজ

ঘটনাচক্রের একমাসে সীমান্তে আগের মতো আর জনস্রোত না দেখা গেলেও, থেমে নেই সহিংসতার মাত্রা। স্যাটেলাইট চিত্র বলছে, এখনও মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন গ্রাম জ্বলছে, হচ্ছে মানুষ হত্যা।

একমাসের তাণ্ডবে রাখাইনের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রাণ ভয়ে রোহিঙ্গারা পালিয়ে চলে এসেছেন বাংলাদেশে। এখনও আসছেন তারা।

এতে সেখানকার মাইলের পর মাইল গ্রামগুলো জনশূন্য, আবার কোথাও কোথাও অবস্থান নিয়েছে স্থানীয় মগরা।

ঘটনার সূত্রপাত
আগস্ট মাসের ২৪ তারিখ দিনগত রাতের কথা (রাত ১২টার পর ২৫ আগস্ট)। সে রাতে রাখাইনে পুলিশ ক্যাম্প ও একটি সেনা আবাসে বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। এর জেরে ‘অভিযানের’ নামে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী নিরস্ত্র রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশুদের ওপর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে। ফলে লাখ লাখ মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য চলে আসছেন।

বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা
জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইএমও) বলছে, সহিংসতার শিকার হয়ে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার লাখ। তবে বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যা সাড়ে পাঁচ লাখ ছাড়িয়েছে। সহিংসতায় প্রাণ গেছে তিন হাজারের বেশি মানুষের। বেসরকারিভাবে এই সংখ্যা দশ হাজার পার করেছে মধ্য সেপ্টেম্বরেই। এখনও রাজ্যে সাংবাদিক ও ত্রাণকর্মীদের অবাধ চলাফেরা নিশ্চিত না হওয়ায় সঠিক বিস্তারিত কোনো তথ্যই মিলছে না। উল্টো সেখানে যারা ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছেন তাদের ওপরও হামলা হচ্ছে। এতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজন জড়িত বলে উল্লেখ করেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম। রোহিঙ্গা ক্যাম্প, ছবি: বাংলানিউজ

রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়া
অক্টোবরে বাংলাদেশ সফরে আসতে পারেন মিয়ানমারের পররাষ্ট্র দফতরের একজন প্রতিমন্ত্রী। তিনি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আলোচনা করবেন বলে জানা গেছে।  আলোচনা করতে ঢাকায় আসতে সম্মত মিয়ানমার

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বার্তা
জাতিসংঘ বলেছে রাখাইনে যা হচ্ছে তা ‘জাতিগত নিধন’ (ethnic cleansing)। সংস্থাটি বারেবারে চাপ প্রয়োগ করেও কোনো কাজে দিচ্ছে না। বিশ্বনেতারা এ নিয়ে কথা বলেছেন, তবুও মিয়ানমার নিজেদের মতো করে ব্যাখা দিচ্ছে এবং অভিযানের নামে মানুষ হত্যা করছে, মানুষজনের ঘরবাড়িতে আগুন দিচ্ছে। নারীদের ওপর গণধর্ষণও চালাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক বিশ্বে তুরস্ক সর্ব প্রথম এই ইস্যুতে প্রতিবাদ করে। দেশটির ফার্স্ট লেডি এমিনি এরদোয়ান কক্সবাজার সফরেও যান। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের নিয়ে যাওয়া হয় রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, রোহিঙ্গা সমস্যার অতিদ্রুত সমাধান দেখতে চান তিনি।  রোহিঙ্গা সংকটে জাতিসংঘের বলিষ্ঠ ভূমিকা চান ট্রাম্প

এই সংকট নিয়ে ব্যাপক আলোচনার মধ্যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭২তম অধিবেশনেও কথা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এই ইস্যুতে ছয়দফা দাবি তুলে ধরেন। তবে পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতির জন্য সংশ্লিষ্টরা চীন, রাশিয়া ও ভারতকে নিয়ে কূটনীতিক পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। পাশাপাশি কফি আনান কমিশনের প্রস্তাব বাস্তবায়নে জোর দিয়েছেন প্রত্যেকেই।  রোহিঙ্গারা মানুষ, পশুর মতো হত্যা করবেন না
    যা আছে আনান কমিশনের সুপারিশে

গণহত্যার একটি বর্ণনা
রাখাইনে সাজানো গোছানো একটি গ্রাম ছিল সোহাবপুর। গ্রামটিকে মরুভূমিতে পরিণত করতে স্থানীয় তরুণদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছে মিয়ানমার সেনারা। বাংলানিউজকে সেই অত্যাচারের কথা বলেন, কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া ওই গ্রামের বাসিন্দা কবির আহমেদ। তার ভাষায়, প্রাণ নিয়ে পালাবার সময় গ্রামের শত শত প্রতিবেশী, বন্ধু, ভাই সমকক্ষদের ঠিক মতো দাফনও করে আসতে পারেননি! হঠাৎ একটি গাড়ি এসে থামে সোহাবপুর গ্রামের রাস্তায়। চালায় অতর্কিত হামলা। সাড়ে ৬শ তরুণকে এক সঙ্গে জমা করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। হাত বাঁধা হয়। প্রথমে তাদের ছুরি দিয়ে জীবিত অবস্থায় কাটা হয় পায়ের গোড়ালি। তারপর কাটা হয় হাতের কব্জি। তরুণদের চিৎকারে ভারি হয়ে উঠে সোহাবপুর গ্রামের বাতাস। সবশেষে কাটা হয় গলা। গলা ঘাড় থেকে আলাদা করে অন্যান্যদের দেখিয়ে উল্লাস করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এমন সময় গ্রামের দুইজন ছেলে কৌশলে হাতের বাঁধন খুলে প্রাণ বাঁচাতে দৌড়ানো শুরু করে। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। তাদের ঘিরে ফেলে স্থানীয় মগরা। তাদের এক পুকুরে রীতিমতো পানিতে ডুবিয়ে মারে মগরা। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী একে একে প্রায় সাড়ে ৬শ তরুণকে হত্যা করে সোহাবপুর গ্রামে। এক মাঠে জড়ো করে ফেলা রাখা হয় মরদেহ। পুরো গ্রামে মাইকিং করা হয়, যারা গ্রাম ছেড়ে বাংলাদেশে না যাবে তাদের সবাইকে একইভাবে হত্যা করা হবে।  সাড়ে ৬শ রোহিঙ্গা ভাইকে দাফনের সুযোগও পাননি কবির!

এমন গণহত্যা কেবল ওই গ্রামেই নয়, রাজ্যের প্রতিটি গ্রামে গ্রামে চলেছে। এই ঘটনাটি একটি উদাহরণ মাত্র। পুরুষদেরই বেশি হত্যা করা হয়েছে। আর নারী ও শিশুদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশে। ক্যাম্পে রোহিঙ্গারা, ছবি: বাংলানিউজ

হত্যার পাশাপাশি গণধর্ষণ
শামিলা (ছদ্মনাম) নামের এক নারী বলছিলেন তার সন্তানদের সামনেই তাকে গণধর্ষণ করে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সদস্যরা। শুধু সেনারাই নয়, এই তালিকায় আছে স্থানীয় মগরাও। এমন ঘটনা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ছাউনিতে ছাউনিতে। আরও পড়ুন লিংকে: সেনাবাহিনী গণধর্ষণ করেছে রোহিঙ্গাদের, মিললো প্রমাণ

মিয়ানমারের বক্তব্য
বাস্তবকে উপেক্ষা করে মিয়ানমার সেনাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং একের পর এক বক্তব্য দিচ্ছেন। তিনি দাবি করছেন, রোহিঙ্গারাই বোমা ফাটাচ্ছে রাজ্যের বিভিন্ন জেলায়! এতেই মানুষজন দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন! আবার তিনি এও বলছেন, মুসলিমরা কেন পালাচ্ছে তা তিনি জানেন না! তাদের না পালাবার কথাও রয়েছে তার মুখে।  রোহিঙ্গারাই বোমা ফাটাচ্ছে, ফের দোষারোপ সেনাপ্রধানের
‘বাঙালি সন্ত্রাসী আক্রমণে’ মর্মাহত মিয়ানমার সেনাপ্রধান!

এদিকে দেশটির স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি সম্প্রতি জাপানের একটি পত্রিকায় সাক্ষাতকার দিয়েছেন। যাতে তিনি বলছেন, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়া শুরু হতে পারে। যা নির্ভর করছে বাংলাদেশের ওপর। তবে তার কিছু দিন আগে রাষ্ট্রীয় ভাষণে সু চি কথা বলেছিলেন সেনাবাহিনীর সুরেই। সব মিলয়ে তার বক্তব্যেও কোনো মিল নেই।  রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়া শুরু হতে পারে: সু চি
রোহিঙ্গারা চলে যাওয়ায় মিয়ানমার উদ্বিগ্ন

রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিম গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক গণআদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন অং সান সু চি এবং সেনা প্রধানসহ বাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্য। মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে আদালত এই রায় দিয়েছে। যদিও এটি প্রতীকী সাজা ঘোষণা।  আন্তর্জাতিক গণ-আদালতে সু চি ও সেনাপ্রধান দোষী সাব্যস্ত

সু চির সমালোচনা
শান্তিতে নোবেলজয়ী সু চির সমালোচনা করেছেন বিশ্বের মানবতাবাদী নেতারা। শান্তিতে নোবেল জয় করেছেন এমন সব ব্যক্তিত্বের কটূ বাক্য থেকেও বাদ যাননি তিনি। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সু চিকে মিথ্যাবাদী বলেও আখ্যা দিয়েছে।

বাংলাদেশ সরকার
বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের চিকিৎসাসেবায় কাজ করছে। সহিংসতার জেরে পালিয়ে আসা আহত রোহিঙ্গাদের সুস্থ করে তুলতে কাজ করা হচ্ছে। এছাড়া মেডিকেল ক্যাম্পের মাধ্যমেও দেওয়া হচ্ছে সেবা।

এছাড়া রোহিঙ্গাদের নিবন্ধনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এজন্য কাজ করছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা।

সীমান্তে মাইন
বান্দরবান সীমান্তে মাইন পুঁতে রাখছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। যা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। এতে রোহিঙ্গারা যারা ফিরতে চাচ্ছেন তারা বিস্ফোরণে মারা যাচ্ছেন। পালিয়ে আসার পথ আছে, কিন্তু বাংলাদেশ থেকে ফিরে যাওয়ার পথ রুদ্ধ করতেই এই মাইন, বলছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। এদিকে একাধিকবার বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে মিয়ানমার, উড়িয়েছে হেলিকপ্টার ও ড্রোন; তাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে কেবল প্রতিবাদ।

শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সহায়তায় কাজ করছে। বাংলাদেশে আগে থেকেই চার লাখের মতো রোহিঙ্গা ছিল। তার ওপর নতুন করে সাড়ে চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নেওয়ায় রোহিঙ্গাদের সংখ্যা নয় লাখের মতো দাঁড়িয়েছে। জাতিসংঘ উদ্বাস্তু সংস্থা আশঙ্কা করছে যে, চলতি বছরের শেষ নাগাদ বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ১০ লাখে উন্নীত হতে পারে। ফলে এ বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার চাপ সামলানো বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়, এতে সংস্থাটিই বলছে, বাংলাদেশকে যেন আরও বেশি সহায়তা করা হয়।  রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশকে আরও সহায়তা করা দরকার: ইউএন

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতিগত দ্বন্দ্বের জেরে ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে দেশটির উত্তর-পূর্ব রাখাইন রাজ্যে বসবাসরত মুসলিম রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপর সহিংসতা চালাচ্ছে দেশটির সেনাবাহিনী। সহিংসতার শিকার হয়ে গত বছরের অক্টোবরেও প্রায় ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। ১৯৭৮ সালে রোহিঙ্গা সমস্যার শুরু, এরপর থেকে দশকের পর দশক রোহিঙ্গা নির্যাতন চালিয়েছে মিয়ানমার; এতে উদ্বাস্তু মানুষ চলে এসেছেন বাংলাদেশে।

সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে শিশুরা, উদ্বেগ ১৩% গর্ভবতী নিয়েও

বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৭
আইএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।