ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

তথ্যপ্রযুক্তি

ম্যাস মিডিয়া-স্যোশাল মিডিয়ার মল্লযুদ্ধ, শেষ কোথায়?

মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪২৩ ঘণ্টা, জুন ১২, ২০১৭
ম্যাস মিডিয়া-স্যোশাল মিডিয়ার মল্লযুদ্ধ, শেষ কোথায়? ম্যাস মিডিয়া-স্যোশাল মিডিয়ার মল্লযুদ্ধ, শেষ কোথায়?

গত ক’বছরে, সুনির্দিষ্ট করে বললে গত দশ বছরে, স্যোশাল মিডিয়া অধিকাংশের জীবনের অবিচ্ছেদ্দ অংশ হয়ে উঠেছে। স্মার্ট ফোন, লাপটপসহ নানা ধরনের পোর্ট্যাবল ডিভাইস হাতে পেয়ে সকলেই সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারে মরিয়া হয়ে উঠেছে। যেনো প্রতিটি দিনের প্রতিটি ঘণ্টায়ই বন্ধু-পরিচিতের সাথে সংযুক্ত থাকা চাই। ম্যাসেঞ্জারে চ্যাটিং করতে হবে, নয়তো মন্তব্য করতে হবে হয় ছবি কিংবা স্ট্যাটাসে। বাজারে কোন পণ্য কোন ব্র্যান্ড সেরা তা জানতে হবে এই সামাজিক মাধ্যমে। পছন্দের তারকা কিংবা সেলিব্রেটি কখন কি করছেন তা ফলো করাও একটা কাজ। এসব এখন সামাজিক মাধ্যমেই জানা যায় কারণ তারাও এই ক্রেজের সুবিধা নিয়ে জনপ্রিয়তা যেমন বাড়াচ্ছেন তেমনি টুপাইস কামিয়েও নিচ্ছেন। এর বাইরে সামাজিক মিডিয়ায় আরও যা পাওয়া যায় তা হচ্ছে- খবর। যা গোটা মিডিয়া ব্যবস্থাকে একটা নাজুক অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যার অবধারিত পরিণতি হিসেবে আজ মল্লযুদ্ধে মেতেছে মূল ধারার গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যম।

২০০৪ সালে টিম ও’রেইলি যখন ও’রেইলি মিডিয়া চালু করে তার নাম দিয়ে দিলেন ওয়েব টু.জিরো তখনও কী তিনি জানতেন এই ধরনের একটি মিডিয়া গোটা বিশ্বে জাল বিছাবে! ওয়েব টু.জিরোর ব্যবহারকারীরা নিজেরাই কনটেন্ট তৈরি করতে পারতেন, পরস্পরের সাথে যোগাযোগ মিথষ্ক্রিয়া এসব করতে পারতেন আর একে অন্যের কাজেও লাগতেন। আজকের যে স্যোশাল মিডিয়া তা সেই ধারনা থেকেই উৎসারিত।


 
শত শত বছরের পুরোনো ম্যাস মিডিয়া নানা প্রযুক্তি ও প্রক্রিয়ায় ভর করে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মাঝে বিস্তৃত হয়েছে। তার বিস্তৃতিও এখন দুনিয়া জোড়া। স্যোশাল মিডিয়ার ব্যবহারকারীরাও এই ম্যাস মিডিয়ার জগতেরই বাসিন্দা।  
 
নানা ফর্মে স্যোশাল মিডিয়া আজ বিশ্ব জুড়ে যোগাযোগের জাল বিস্তার করেছে। ব্যবসায় নেটওয়াকিংয়ে লিংকড ইন, ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম হিসেবে রয়েছে ইউটিউব, সামাজিক নেটওয়ার্কিং সাইটের মধ্যে রয়েছে ফেসবুক, টুইটার। এমন আরও অনেক নাম।
 
সার্বিকভাবে মিডিয়া সেক্টরটির সাথে আমরা ম্যাস মিডিয়াকে কিছুটা গুলিয়ে ফেলি। যে কারণে স্যোশাল মিডিয়া ও ম্যাস মিডিয়ার পার্থক্যটাও অনেকের কাছে স্পষ্ট থাকে না। তাদের জন্য বলে রাখি প্রধানতম পার্থক্যটি হচ্ছে- ম্যাস মিডিয়ায় ব্যবহারকারী অনেকটা অক্রিয় অবস্থানে থাকেন। আর স্যোশাল মিডিয়ার পুরো প্রক্রিয়াটি এর ব্যবহারকারীকে ঘিরেই আবর্তিত। এখানে ব্যবহারকারী নিজেই কনটেন্ট তৈরি করছেন, আবার অপরের কনটেন্টের নিজেই পাঠক কিংবা দর্শক। আর পারষ্পরিক মিথষ্ক্রিয়া ও সহযোগিতারও একটি অনন্য প্ল্যাটফর্ম এই সামাজিক মাধ্যম।
 
আগেই বলেছি, গত ১০ বছরে এই সামাজিক মাধ্যম আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। প্রতিদিনই সামাজিক মিডিয়া নেটওয়ার্কে যোগ হচ্ছে নতুন ব্যবহারকারী। শত কোটি মানুষ যখন এইসব মিডিয়ায় সম্পৃক্ত তথন কর্পোরেটগুলোও তাদের ব্রান্ডের বাজার খুঁজতে এর সুবিধা নিচ্ছে। তাদের পণ্যের মার্কেটিংয়ে ক্যাম্পেইন চালাচ্ছে এই প্ল্যাটফর্মে। এখানেই তারা খুঁজে পাচ্ছে সম্ভাব্য ক্রেতা। তাদের কনটেন্টে তৈরি হচ্ছে সামাজিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে কোন মিডিয়া জনগণের ওপর সবচেয়ে বেশি মাত্রায় প্রভাব বিস্তার করতে পারে? কিংবা গঠন করতে পারে কার্যকর জনমত?
 
গত শতাব্দীটি ছিলো ম্যাস মিডিয়ার। সকল ব্যক্তি সংগঠন, প্রতিষ্ঠানের কণ্ঠস্বরও হয়ে উঠেছিলো এই মাধ্যম। আধুনিক সংস্কৃতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ শক্তিতে পরিণত হয়েছিলো, যাকে সমাজতাত্ত্বিকরা মেডিয়েটেড কালচার বলতেও ছাড়েননি। আর সে কারণেই ম্যাস মিডিয়া বিশ্বজুড়ে পেয়েছে ‘মূলধারার মিডিয়া’র তকমা। সমাজের অধিকাংশ মানুষের আশাভরসার স্থল হয়ে উঠেছে এই মাধ্যম। আর তারাও সেই ধরনের কনটেন্টই বেশি বেশি তৈরি করছে যা এই অধিকাংশ মানুষ চায়।
 
জনমত তৈরিতে কিংবা বিতর্কিত কোনও ইস্যুতে বিরাজমান মতামতকে কাঠামো দিতে মিডিয়া ভূমিকা রাখে। এক পর্যায়ে এই ক্ষমতার অবৈধ ব্যবহারও দেখা গেছে। ফলে ম্যাস মিডিয়া বিশেষ করে যুদ্ধাবস্থায় হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক প্রোপাগ্যান্ডার অন্যতম হাতিয়ার। যার দুষ্ট ব্যবহারে জনমত নিজের পক্ষে নিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটে চলেছে অহরহ।
 
ম্যাস মিডিয়ার বিজ্ঞাপনী আয়ও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। মিডিয়া সেক্টরের প্রধানতম আয়ের খাতেই এই বিজ্ঞাপন। ফলে কর্পোরেশনের দিকে ম্যাস মিডিয়া নিরপক্ষে দৃষ্টি ফেলতে পারছে কি না সে প্রশ্নও যথেষ্ঠই পুরোনো।
 
এর মাঝেই এসে যায় ইন্টারনেট। গত দুই দশক ইন্টারনেটের হানায় মিডিয়া জগতে কিছুটা ঝাঁকি লাগে। ওয়েব টু.জিরোর যোগাযোগের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে দেখা দেয়। আর পরিবর্তনটা যে এত দ্রুত হবে তা ছিলো কল্পনারও অতীত। ইন্টারনেট ও তার দ্রুত দ্রুত বিবর্তন ম্যাস মিডিয়ার জন্য হয়ে ওঠে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
 
আসে অনলাইন সংবাদমাধ্যম। বিষয়টি এত সহজ আর এতটাই স্বাভাবিক হয়ে ওঠে যে নিউ মিডিয়ার তকমা পেয়ে যায় খুব দ্রুত। ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠতে থাকে এই ধরনের সংবাদ মাধ্যম। আর তাতে অবস্থা এমন হয় যে, যে কেহই হয়ে যেতে পারেন সাংবাদিক। দ্রুতই এসে পড়ে মোবাইল ফোনসহ আরও কিছু পোর্ট্যাবল ডিভাইস। ফলে সাংবাদিকরা হয়ে ওঠেন রিয়েলটাইম ব্রডকাস্টার। এতে সাংবাদিকতায়ও মিথষ্ক্রিয়া বেড়ে যায়। তখনই জয়জয়কার পড়ে যায় সামাজিক মাধ্যমের। সামাজিক মিডিয়ার চ্যানেলগুলো ব্যবহার করে     মূলধারার সাংবাদিকতাও ছড়ায় সমান দ্রুততায়।
 
এদিকে হঠাৎ করেই কর্পোরেটগুলোর নজর পড়ে যায় সামাজিক মাধ্যমে। অনেকটা ফ্রি এই প্ল্যাটফর্মকে তারাও ব্যক্তির মতো করেই ব্যবহার করতে শুরু করে। ম্যাকেনসির একটি সাম্প্রতিক গবেষণা দেখিয়েছে বিশ্বের ৮৩ শতাংশ কর্পোরেশন এখন অন্তত একটি সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করছে তাদের ব্র্যান্ডিং কিংবা বিজ্ঞাপনী প্রচারে।
 
এত্তসবে প্রশ্ন উঠতেই পারে- সার্বিকভাবে মিডিয়া সেক্টর কি আজ বিপন্ন। উত্তরটি সহজ ও এক কথায় দেওয়া সম্ভব, তা হচ্ছে- ‘না’।
 
আইসেনসিয়া নামে একটি আন্তর্জাতিক মিডিয়া ইন্টলিজেন্স গ্রুপ’র একটি সাম্প্রতিক গবেষণা মতে এজেন্ডা সেটিং কিংবা খবর সরবরাহের দায়িত্বের বিচারে ম্যাস মিডিয়ার আধিপত্যই রয়ে গেছে। তবে তা পরিবর্তনও হচ্ছে ধীরে ধীরে।
 
কীভাবে? সে প্রশ্ন উঠবে। দ্য পিউ রিসার্চ সেন্টার তার ২০১৩ সালের গবেষণাতেই দেখিয়েছিলো ম্যাস মিডিয়ার রিপোর্ট তার সংখ্যা ও মান উভয় দিকের বিচারেই পড়তির দিকে।
 
ইন্টারনেট এসে যাওয়ার পরপরই মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রিতে যে ডাউনসাইজিংয়ের খাড়া দেখেছি তারই অনিবার্য পরিণতি এটা। চারিদিকে বন্ধ করো ছাঁটাই করো, একীভূত করো এমন একটা রব উঠে গিয়েছেলো। ফলে খবরের সংখ্যা যেমন কমেছে, মানও পড়ে গেছে।
 
পিউ রিসার্চ তখনই দেখিয়েছিলো ব্যাপকহারে মানুষ অনলাইনেই খবর পড়তে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। চার বছর আগের সে গবেষণায় যা দেখা গেছে বর্তমান পরিস্থিতি তার চেয়ে অনেক গভীরে হবে সেটাই স্বাভাবিক।
 
স্যোশাল মিডিয়াও এক পর্যায়ে নিউজ কনটেন্ট বানাতে শুরু করেছে। তাদের কনটেন্টের মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ম্যাস মিডিয়ার কনটেন্টের তুলনায় গুন বিচারে অনেক পিছিয়ে বটে। কিন্তু স্যোশাল মিডিয়ায় খবর কনটেন্টের অভাবও নেই। কারণ মূল ধারার ম্যাস মিডিয়াগুলোই তাদের কনটেন্টকে বেশি পাঠকের কাছে পৌঁছে দিকে স্যোশাল মিডিয়াকে বাহন হিসেবে ব্যবহার করছে।
 
ফেসবুক-টুইটারে তারা নিজেদের পাতা খুলে প্রচার চালিয়ে, এমনকি ফেসবুককে পয়সা দিয়ে তবেই বাড়াচ্ছে ফলোয়ার, লাইক।
 
সম্প্রতি বিবিসি চালু করেছে স্যোশাল ফার্স্ট ক্যাম্পেইন। এই সংবাদমাধ্যম তার খবরটি আর নিজের সাইটে ব্রেক করছে না। ফেসবুকে প্রথম প্রকাশ করছে। এরপর সাইটে দিচ্ছে। আবার সাইটের খবরটিও শেয়ার করছে ফেসবুক টুইটারে।  
 
এতে কি সংবাদমাধ্যম তার বৈশিষ্ট্য ও চরিত্র হারাচ্ছে না? সে নিয়ে দুই পক্ষে মত দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে আইসেনসিয়া তার একটি রিপোর্টে লিখেছে ২৪-ঘণ্টার নিউজ সাইকেল এখন প্রাকারান্তরে মৃত। আমরা আসলে এখন খবরের আবহে বাস করছি। আমাদের চারিদিকেই খবর। কোনও একটি একক সূত্র থেকে খবর আসার দিন শেষ। যে যেখানে যেভাবে পাচ্ছে খবর ছড়িয়ে দিচ্ছে। স্যোশাল মিডিয়া যার অন্যতম বাহন। এর শেষ কোথায় কেউ জানে না।
 
বাংলাদেশ সময়: ১০২২ ঘণ্টা, জুন ১২, ২০১৭
এমএমকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।